Wednesday, November 2, 2016

আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট

"আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট"। এই কথামালা আমরা প্রায়শই বলে থাকি। কখনো কি এর মুখোমুখি হয়েছি?

হ্যাঁ, জীবনের এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি হয়েছি। বাংলাদেশী গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার 'আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে' বৃত্তবন্দী হয়ে পড়েছে আমার আজীবনের স্বপ্নেরা।

অর্থ ও সামাজিকতা- এই দুই সোশ্যাল ফোবিয়ার নির্মম আঘাত থেকে আর দশজনের মত আমিও নিজেকে হেফাজত করার অবিরত সংগ্রামে আছি। জানি না সামনে বিজয় না কি পরাজয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে যৌবনের সেরা সময়ে গনমানুষের পাশে দাঁড়ানোর বজ্রশপথে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হেঁটেছিলাম। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সাথে লড়াই করার অনেক উপাদান ছিল সত্য, ঘাটতি ছিল টাকায়। টাকার চোট থাকলে ১৬ ভোটের গ্যাপ হয়তো থাকতো না! মানবিক দুর্বলতায় প্রায়শই ভাবি- আমার মত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য রাজনীতির মাঠে বক্তৃতা করা সাজে, টাকাওয়ালাদের বিজয় মিছিলের মাঝে শ্লোগান দেয়া যেতে পারে; কিন্তু ভোটের মাঠে আমরা বড্ড অনুপোযুক্ত!

নির্বাচনের পর বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন কাছে আসে। তাদের চোখের ভাষা বুঝতে পারি বেশ! বুঝতে পারি তাদের আকাঙ্ক্ষা, অব্যক্ত কথামালা! কিন্তু!!!!!!! তখন আনমনে চুপসে যাই। মুখে কৃত্রিম হাসির টোল ফেলে ভেতরের দীর্ঘশ্বাসকে লুকিয়ে রাখি।

আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা যখন বলেন, গ্রামে ভাল একটা বাড়ি তৈরি করুন, এই বাজাজ মোটরসাইকেল দিয়ে আর হবে না- ভাল গাড়ি কিনুন, তখন মুখাবয়বে অটোমেটিক এক হাসির আবেশ চলে আসে। হেসেই বুঝিয়ে দিই- হুম, সহসাই আপনাদের দাবী পূরুন হবে।

আমি মানুষটা বন্ধুপ্রিয়। বন্ধুদের সাথে চলতে ভালবাসি। এলাকায় আসলেই স্কুল ফিল্ডের শেডে বসি। বন্ধুরা হরেক রকমের আলোচনা করে। মাস্টার্স পাশ করা বন্ধুরা স্বভাবতই চাকুরীর ইস্যু নিয়ে কথা বলে। তুমুল আলোচনা। কে কোথায় চাকুরী করছে, কার চাকরীর কি সমস্যা, কি সম্ভবনা - তা নিয়ে বেশ সরগরম আড্ডা। যে কোন আলোচনায় সবাই আমার মতামত জানতে চায়; কিন্তু চাকুরীর বিষয়টা এলেই সবাই আমাকে এড়িয়ে যায়। পলিটিশিয়ান ব্যক্তি চাকরীর কি বুঝবে? ওরা ধরেই নিয়েছে, আমাকে দিয়ে চাকরী হবে না। অথচ ওরাও জানে- ওদের ক্লাসে কখনো সেকেন্ড হইনি। একাডেমিক জীবনও বেশ ভাল করেই সমাপ্ত করেছি। কিন্তু জীবনের দর্শনের ভিন্নতায় ওরা আমাকে ব্যর্থদের কাতারেই ফেলে দিয়েছে। আমার চাকুরী নেই। ভাল একটা চাকুরী নেই। ওরাও জানে- আমি জব প্রিপারেশন মাস কয়েক নিলেই, রুটি রোজিগারে ঠেকবো না ইনশাআল্লাহ।

প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে সফরে বেড়িয়েছি। পথে স্ত্রীর সম্পর্কিত আংকেলের সাথে দেখা। ও যখন উচ্ছ্বাসের সাথে আমাকে ইন্ট্রোডিউস করে দিচ্ছিল, তখন আংকেলের প্রথম প্রশ্ন জামাই ঢাকাতে কি চাকুরী করে? আমি দেখলাম- ওর বিব্রত মুখে একটু আগের উচ্ছ্বাস আর নেই। থাকার কথাও নয়। শ্বাশুড়ী যখন তার আত্মীয়দের সামনে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন, তখন একটা সংকটের তৈরি হয়। জামাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, তো চাকুরী কি? যখন শোনে বিবিএ, এমবিএ করেছি- তখন ডাইরেক্ট প্রশ্ন কোন ব্যাংকে ঢুকেছি?

আমার মা সমাজে মাথা উঁচু করে বলতে পারেনা - জানো আপা, আমার ছেলে এবার ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে প্রমোশন পেয়েছে। আন্টিরা যখন মাকে তার মেধাবী বড় সন্তানের জব আইডেন্টিটির প্রশ্ন ছোড়েন, তখন ওনি উদাস মনে বলেন - কি বলবো আপা, পলিটিক্সের ঘোড়ারোগ ধরেছে।

ছোটবেলা বাবাকে দেখে স্বপ্ন গেঁথেছি- রাজনীতিবিদ হবো। আর কিছু করবোনা। গনমানুষের পাশে দাঁড়াবো। সেই স্বপ্নকে আজতক টেনে লম্বা করেছি। সম্ভবত আমি ইলাস্টিক টেনেছি। টানতে টানতে এখন ছিঁড়ে যাবার উপক্রম।

'আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট' এর যাঁতাকলে পড়ে পিষে যাচ্ছি। এই সমাজ আমাকে ভেঙচি কেটে বলছে- ভাত নেই পেটে, রসগোল্লা খাওয়ার বায়না ধরেছে। এখানে টাকা চাই, প্রচুর টাকা। সার্টিফিকেট আর মেধায় সম্মান খুঁজলে পণ্ডশ্রম হবে; সন্মান আর টাকা খালাতো ভাই-ভাই।

এই সমাজ একটা আইডেন্টিটি কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়ার প্রণোদনা দিচ্ছে অবিরত। জব আইডেন্টিটি। জব, চাকুরী, অফিসার। কে কত বেশী সফল- তার মানদণ্ড কে কত ভাল জব করে।

আমার মত যারা স্রোতের বিপরীতে চলার ইরাদা করেছেন - তারা এই আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার আক্রমণ থেকে মুক্তির উপায় সহসাই খুঁজে বের করুন। নইলে আপনার বিপরীত স্রোত প্রবাহমান স্রোতের টানে নিমিষেই দিক বদলে ফেলতে বাধ্য হবে।

0 comments:

Post a Comment