Wednesday, November 2, 2016

মুসলিম মানসে ‘ইনশাআল্লাহ্‌’


আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলস বিমানবন্দর। ২৬ বছরের খায়রুদ্দিন মাখজুমি। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী। ৯ ই এপ্রিল লস অ্যাঞ্জেলস থেকে সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের বিমানে অকল্যান্ড যাচ্ছিলেন।


পরদিনই তার জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের আমেরিকার একাডেমিক ব্রিলিয়ান্টদের সম্মানে আয়োজিত ডিনারে অংশ নেয়ার কথা ছিল। এটা নিয়ে মাখজুমি দারুণ উত্তেজিত ছিলেন। তিনি বিমানে উঠার পর তার চাচাকে ফোন করেন। ওকল্যান্ডে পৌঁছানোর পর চাচা তাকে ফোন দেওয়ার কথা বলেন।


জবাবে তিনি বলেন- ইনশাআল্লাহ। মাখজুমির মুখে এ কথা শোনার পর পাশে সিটে বসা নারী যাত্রী দৌড়ে ক্রুদের কাছে ছুটে যান। মাখজুমি ভেবেছিলেন উচ্চঃস্বরে কথা বলার ব্যাপারে তিনি আপত্তি জানাতে গেছেন। কিন্তু দুই মিনিট পরই পুলিশ নিয়ে আসেন বিমানের এক কর্মকর্তা।


তাদের সঙ্গে থাকা গোয়েন্দা কুকুর তার ব্যাগ শুঁকতে থাকে। তার মানিব্যাগ কেড়ে নেয় এবং ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা জানতে চায়। এরপরই তাকে জোর করে বিমান থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ মাখজুমির ফোন রেকর্ড চেক করে এবং ইনশাআল্লাহ্‌র ব্যাখ্যা পেয়ে আট ঘন্টা পরে অকল্যান্ড যেতে দিয়েছিল। এই আলোচিত ‘ইনশাআল্লাহ’ তখন বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনামে পরিণত হয়েছিল। নিউইয়র্ক টাইমস শিরোনাম লিখেছিলঃ Inshallah Is Good for Everyone। 
আরবি ইনশাআল্লাহ শব্দের অর্থ- আল্লাহ চাহেন তো বা আল্লাহর ইচ্ছায় ('god-willing' or 'if god is willing')। শব্দটি মুসলমানরা হর-হামেশাই বলে থাকেন। এটা মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিশেষত্ব। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের ভাষার ভিন্নতা থাকলেও ভবিষ্যতের কোন কাজ সম্পাদনের সম্মতি ও প্রতিশ্রুতি বুঝাতে সকলেই আরবী ‘ইনশাআল্লাহ’ শব্দ ব্যবহার করে। মূলতঃ ইনশাআল্লাহ বলার মাধ্যমে ভবিষ্যতে সম্মাদিতব্য কোন কাজ, আনুগত্য, প্রতিশ্রুতি পালনের ক্ষেত্রে মুসলমানেরা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র সাহায্য কামনা করে এবং এর মাধ্যমে বিশ্বাস স্থাপন করা হয় যে- আল্লাহ তায়ালার কোন না কোনভাবে সহযোগীতা ব্যতিত ব্যক্তির পক্ষে তা সম্পাদন করা সম্ভব নয়। এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে- দুটি পক্ষের প্রতিশ্রুতির কেন্দ্রবিন্দু আল্লাহ তায়ালা; মানে ‘আল্লাহ চাহে তো আমি করবো’।


আপনি মুসলিমদের কথাবার্তার মাঝে অসংখ্যবার ইনশাআল্লাহ্‌র ব্যবহার দেখতে পাবেন। দৈনন্দিন কথা-বার্তায় ইনশাআল্লাহ্‌ একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে যখন কারো কাছ থেকে ইনশাআল্লাহ্‌ শোনেন, তখন অপরজন ধরেই নেন ‘কাজটি আর হচ্ছে না’। আল্লাহ্‌কে সাথে রেখে কৃত প্রতিশ্রুতি অবলীলায় ভেঙ্গে ফেলার নামই যেন ‘ইনশাআল্লাহ্‌’। একজন মুসলিম কর্মকর্তা চিৎকার করে তার অধীনস্ত সহকর্মীকে বলছে- না, না, আমি কোন ইনশাআল্লাহ্‌ শুনতে চাই না; আপনি সোজা বলুন- কাজটি করবেন কি করবেন না। তখনও সহকর্মী বলছেন- ইনশাআল্লাহ্‌। বাংলাভাষী মুসলিম সমাজে একদিকে ইনশাআল্লাহ্‌র সঠিক অর্থ ও বিশেষত্ব যেমন কখনো শিক্ষা দেয়া হয়নি, অপরদিকে এর অপব্যবহারের পরিণাম সম্পর্কেও কোন ধারণা দেয়া হয়নি।


এখন আমরা এই নিবন্ধে ইনশাআল্লাহ্‌র অবস্থান ও মর্যাদা জানার চেষ্টা করবো। একই সাথে ইনশাআল্লাহ্‌র অপব্যবহারের এক ভয়ংকর চিত্র উপস্থাপন করে মুক্তির উপায় হিসেবে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা পেশ করবো। ওয়া মা তৌফিকি ইল্লা বিল্লাহ। 
ইনশাআল্লাহ্‌র পেছনের গল্পঃ
রাসূল সাঃ এর শুরুর নবুওয়তী জীবনের শুরুতে দাওয়াতী কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় কুরাইশদের তুমুল অভিযোগ ও শত্রুতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। জাহেলিয়াতের ধ্বজাধারীরা একত্ববাদের সম্মোহনী দাওয়াতকে ভয় পেয়ে বসেছিল। মানবতার বন্ধু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে মিথ্যাবাদী, পাগল, যাদুকর বলে প্রাথমিক মানসিক আঘাত করেছিল। সেখানে সফল হতে না পেরে যেকোন কৌশলে রাসূলুল্লাহকে থামিয়ে দিতে চাইছিল। কৌশলের অংশ হিসেবে মক্কার কুরাইশরা নযর বিন হারিছ এবং উকবা বিন আবু মঈতকে মদীনার ইহুদী আলেমদের কাছে পাঠাল। তারা তাদের উভয়কে বললঃ তোমরা মদীনায় যাও এবং মুহাম্মাদ এর ব্যাপারে তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর। তোমার তাদেরকে মুহাম্মাদের গুণাগুণ সম্পর্কেও বল এবং সে যা বলছে, সে সম্পর্কেও তাদেরকে খবর দাও। কেননা তারা আহলে কিতাব। তাদের কাছে নবী-রাসূলদের সম্পর্কে এমন জ্ঞান আছে, যা আমাদের কাছে নেই।
সুতরাং নযর বিন হারিছ এবং উকবাহ মদীনায় গিয়ে ইহুদী আলেমদের কাছে রাসূল (সাঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। তারা ইহুদী আলেমদের কাছে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর বৈশিষ্ট এবং তাঁর কিছু খবরাদিও বর্ণনা করল। পরিশেষে তারা বললঃ তোমরা তাওরাতের অধিকারী। তাই আমরা তোমাদের কাছে আমাদের নবুওয়তের দাবীদার (মুহাম্মাদ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে এসেছি। সুতরাং আমাদেরকে তার সম্পর্কে কিছু সংবাদ দাও এবং এমন কিছু বিষয় শিখিয়ে দাও, যার দ্বারা আমরা তাঁকে পরীক্ষা করতে পারি।
এবার ইহুদী আলেমরা তাদেরকে বললঃ তোমরা তাঁকে তিনটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর। সে যদি ৩ টির ২ টির উত্তর দিতে পারে এবং ৩য় টির উত্তর না দেয়, তাহলে সে সত্য নবী। আর যদি ২টির উত্তর না পারে, সে একজন মিথ্যুক। তোমরা তার ব্যাপারে তখন যা ইচ্ছা তাই করতে পার।
এবার কুরাইশরা খুবই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। আব্দুল্লাহর ছেলে মুহাম্মাদকে আটকানোর মওকা পেয়ে গেছে ! মুহাম্মাদ তো আর আহলে কিতাবদের কেউ নয়; এমনকি সে অশিক্ষিত। এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয় সে দিতে পারবে না। প্রশ্ন তিনটি ছিলঃ
১) তোমরা তাকে ঐ সমস্ত যুবকদের সম্পর্কে (আসহাবে কাহাফ) জিজ্ঞেস কর, যারা অতীত কালে দ্বীন নিয়ে পলায়ন করেছিল। তাদের অবস্থা কি হয়েছিল? কেননা তাদের ঘটনাটি ছিল সত্যিই বিস্ময়কর।
২) তোমরা তাকে আল্লাহর সেই মুমিন বান্দা (যুল কারনাইন) সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর, যিনি পূর্ব ও পশ্চিমের সব দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। তার খবর কি ছিল?
৩) তোমরা তাঁকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর। এটি কি?


প্রশ্নগুলো নিয়ে নযর এবং উকবাহ মক্কার কুরাইশদের নিকট ফেরত আসল। তারা কুরাইশদেরকে বললঃ আমরা মুহাম্মাদ ও তোমাদের মাঝে ফয়সালাকারী একটি বিষয় নিয়ে এসেছি। এই বলে তারা প্রশ্নগুলো সম্পর্কে কুরাইশদেরকে জানাল এবং বললঃ মদীনার ইহুদী আলেমগণ আমাদেরকে বলেছে, আমরা যেন প্রশ্নগুলো মুহাম্মাদের সামনে পেশ করি। সুতরাং তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট আগমণ করল এবং উপরোক্ত তিনটি প্রশ্ন করল। তিনি বললেনঃ ‘আগামীকাল আমি তোমাদেরকে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিব’। কিন্তু তিনি ইনশাআল্লাহ্ বলতে ভুলে গেলেন। কাফেররা আগামীকালের ওয়াদা নিয়ে চলে গেল। ইনশাআল্লাহ্ না বলার কারণে ১৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরও এ ব্যাপারে কোন অহী আসল না এবং জীবরাইল (আঃ) আগমণ করলনা।
ঐ দিকে মক্কার কুরাইশরা বলাবলি করতে লাগলঃ মুহাম্মাদ আগামীকালের ওয়াদা করেছে। আর আজ ১৫ দিন হল। এখন পর্যন্ত আমাদের প্রশ্নগুলোর কোন উত্তরই দিতে পারে নি। এতে রাসূল (সাঃ) চিন্তিত হলেন এবং বিষয়টি তাঁর কাছে কঠিন আকার ধারণ করল। অতঃপর ১৫ দিন পর জীবরাইল (আঃ) সূরা কাহাফসহ অবতীর্ণ হলেন। তাতে আসহাবে কাহাফের ঘটনা, যুল কারনাইন বাদশার ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আছে এবং এই সূরাতে ৩য় প্রশ্ন রুহ সম্পর্কে কোন আলোচনা নেই। আল্লাহ্‌র রাসূল পরীক্ষায় উৎরে গেলেন।


এই সূরার ২৩ ও ২৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা পরিস্কার ভাষায় রাসূল (সাঃ) সতর্ক করে দিয়ে বললেনঃ “আপনি কোন কাজের বিষয়ে বলবেন না যে, সেটি আমি আগামী কাল করব। ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে’ বলা ব্যতিরেকে। যখন ভুলে যান, তখন আপনার পালনকর্তাকে স্মরণ করুন এবং বলুনঃ আশা করি আমার পালনকর্তা আমাকে এর চাইতেও নিকটতম সত্যের পথ নির্দেশ করবেন।’’ 
এই আয়াতের মাধ্যমেই ইনশাআল্লাহ্‌ শব্দের মর্যাদা সুরক্ষিত হয়েছিল এবং তখন থেকেই এটি মুসলমানদের প্রিয় উক্তি। আমরা ইনশাআল্লাহ্‌ পেয়েছি আল কুরআনের পবিত্র আয়াতের মাধ্যমে। সূতরাং এই শব্দের মর্যাদা-সম্মান নিয়ে আর কোন আলোচনা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না।
কেন ইনশাআল্লাহ্‌?
ইসলামিক স্কলারবৃন্দ ইনশাআল্লাহ্‌ বলার ৩ টি যৌক্তিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন যা শব্দটিকে অসাধারণত্ব এনে দিয়েছে।


একঃ যখন আমরা বলি- “আমি কাজটি আগামীকাল করবো’- তখন টেকনিক্যালি মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়। পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে বাস্তবতার নিরিখেই অনেক সময়ে এমনকিছুর মুখোমুখি হতে হয়, যেখানে আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তখন স্বভাবতই সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু টেকনিক্যালি চিন্তা করলে আমি প্রতিশ্রতি ভঙ্গ করলাম এবং আগের দিন মিথ্যা বলেছিলাম বলে প্রমাণিত হলাম। কিন্তু ইনশাআল্লাহ্‌ বলার মাধ্যমে আমার নিয়ন্ত্রণের বাহিরের অপারগতার কারণে দায়মুক্তি পেতে পারি; অন্তত মিথ্যাচারী সাব্যস্ত হওয়া থেকে মুক্তি পেতে পারি।


দুইঃ ধরুন আমরা একটি কর্মব্যস্ত আগামীকালের গোছালো পরিকল্পনা আঁকলাম। অনেক কাজ, অফিসিয়াল মিটিং, ক্লায়েন্ট ডিলিং, ফ্রেন্ডস পার্টি, একাডেমিক ও প্রফেশনাল অধ্যয়ন, প্রিয়জনের সাথে কিছুক্ষণ। আগামীকাল ঠিকই আজকের দিন হয়ে সামনে চলে আসলো কিন্তু বাস্তবিক ও যৌক্তিক কিছু কারণে শিডিউল ও টাইমিং ঠিকঠাক হলো না। কিছু পরিকল্পনা বাদ দিতে বাধ্য হতে হলো। দিনশেষে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের হিসেব কষতে বসে হতাশ ও বিমর্ষ হতে হলো। গতকাল যা পরিকল্পনা নিয়েছি তার অনেক কাজই তো করতে পারিনি। কিন্তু পরিকল্পনা নেয়ার সময় যদি আল্লাহর কাছে সহযোগীতা ও সামর্থ চেয়ে ইনশাআল্লাহ্‌ বলে সামনে এগিয়ে যাওয়া হতো, তখন অবাস্তবায়িত পরিকল্পনার তালিকা হাতে নিয়ে শান্ত মাথায় ভাবনারা এসে বলতো- আল্লাহ চাননি তাই এসব কাজ হয়নি এবং আল্লাহ্‌ যেভাবে আজ দিন কাটিয়েছেন তাতে আলহামদুলিল্লাহ। হতাশ না হয়ে তখন অসমাপ্ত কাজের সমাপ্তিকল্পে পরবর্তী দিনের দৃঢ় পরিকল্পনায় ডুব দিব। 
তিনঃ যখন আমরা ইনশাআল্লাহ্‌ বলি- তখন আল্টিমেটলি আল্লাহ্‌ তায়ালার কাছে আমাদের গৃহীত পরিকল্পনার বাস্তবায়নের অনুমতি প্রার্থনা করি এবং কাজটি সফলভাবে সম্পাদনের দায়িত্ব বান্দা ও মালিক উভয়ের জিম্মাদারীতে ঠেলে দিই। কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের এমন বিনয়ী আকাঙ্ক্ষা এক আধ্যাত্মিক উন্মেষ এনে দেয়।


এই হলো ইনশাআল্লাহ্‌ বলার যৌক্তিক কারণ এবং বাস্তবতা। এখন দেখবো- কিভাবে আমরা এই পবিত্র শব্দের অপব্যবহার করি। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে ইনশাআল্লাহ্‌র যথার্থ প্রয়োগ থেকে কতদূরে আছি। নিজের জিজ্ঞাসা করতে হবে কেন এসব হচ্ছে? কেন আমরা ইনশাআল্লাহ্‌র অপব্যবহার করছি?
ইনশাআল্লাহ্‌র অপব্যবহার


প্রত্যেকেই ‘না’ বলতে অপছন্দ করেন। ‘না’ বলার মাধ্যমে অশ্রদ্ধাবোধ ও অসম্মান প্রকাশ পায় বলে এক ধরনের হাইপোথেসিস তৈরী আছে। অন্যের কাছে নিজের ব্যক্তিত্ব বিনষ্ট হয়। আমরা সবাই ই ‘না’ বলা থেকে মুক্তি চাই। ঠিক এ জায়গাতেই মুসলমান হিসেবে আমরা একটা দারুন সুবিধা (Advantage) পাই। আমরা ‘না’ থেকে বাঁচতে অত্যন্ত চৌকস একটি শব্দ ‘ইনশাআল্লাহ্‌’ ধর্মীয় উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে আছি। সরাসরি ‘না’ বলা কঠিন; তাই বলে দিই ‘ইনশাআল্লাহ্‌’। এটা আমাদের দায়মুক্তির দিগন্ত উন্মোচন করে দেয়। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে বলতে পারি- আমার তো কাজটি করার ইচ্ছে ও আগ্রহ ছিলই; কিন্তু আল্লাহ্‌ চাননি তাই করতে পারিনি। এভাবে আমরা মানসিকভাবে তৃপ্ত থাকার রসদ খুঁজি। অনুতপ্ত হৃদয়ের বদলে আমরা যুক্তিপ্রবণ হৃদয়কে প্রতিস্থাপন করি।


এবার চলুন একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গভীরভাবে চিন্তা করি। ‘ইনশাআল্লাহ্‌’ বলে যখন আমরা কোন আসন্ন কাজে যথাযথ আগ্রহ, উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার ঘাটতি রাখি অথবা ন্যূনতম কোন দূর্বলতা প্রদর্শন করি, তখন প্রকারান্তরে আল্লাহ্‌ তায়ালাকেই উপেক্ষা করি। কেন? কারণ, ‘ইনশাআল্লাহ্‌’ বলে আমরা কোন কর্ম সম্পাদনের প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরে যখন তা বাস্তবায়নের জন্য কোন প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ নিই না কিম্বা নামেমাত্র সামান্য প্রচেষ্টা নিই, তখন বাই ডেফিনেশন আমরা আমাদের দূর্বলতার জন্য আল্লাহকেই দোষারোপ করি। আল্লাহ্‌ চাইলে তো হতো, আল্লাহ্‌ চাননি তাই হয় নি বলে আমরা কত বড় কথা বলছি তা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছি? আল্লাহ্‌ কিভাবে কাজ করাতে চান, কিভাবে চান না- তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করি আমাদের প্রচেষ্টাহীন অলস ভূমিকার উপর ভিত্তি করে।


মুসলমান হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও পছন্দের ক্ষমতা দান করেছেন। মহান রব কর্ম সম্পাদনের নিমিত্তে হৃদয়-মন ও শরীরকে ব্যবহার করার স্বাধীনতা দিয়েছেন। যদি কোনকিছু আমাদের সামর্থ ও নিয়ন্ত্রণের বাহিরে যায় এবং তার দরুন আমরা প্রতিশ্রুত কাজের আঞ্জাম দিতে না পারি, তাহলে বিশ্বাস করে নিতে হবে নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তায়ালা এই কাজটির জন্যে আমাকে কবুল করেন নি। এই অপারগতার মাঝেই আমার জন্য কল্যান আছে। কিন্তু যেখানে আমার কোন উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় ছিল না, সেখানে কিভাবে আল্লাহ্‌র ইচ্ছে/অনিচ্ছা নিয়ে কথা বলে নিজের দায়মুক্তি খুঁজি?
ইনশাআল্লাহ্‌র অপব্যবহার রোধে করে আসুন ‘না’ বলা শিখি :


মুসলিম হিসেবে আমাদের ইনশাআল্লাহ্‌ শব্দের ব্র্যান্ডিং নতুন করে শুরু করতে হবে। আমাদের এমন এক প্রান্তবিন্দুতে পৌছতে হবে যেখানে ‘ইনশাআল্লাহ্‌’ শব্দ শুনলে পৃথিবীবাসী বিশ্বাস করবে-‘হ্যাঁ, নিশ্চয় কাজটি হবে’। আমরা যখন ‘ইনশাআল্লাহ্‌’ বলবো তখন মানুষ আস্থার এক অনুপম পরশের ছোঁয়া পাবে। আমার ইনশাআল্লাহ্‌ অর্থ হচ্ছে- আল্লাহ্‌ চাহে তো সম্ভব সবটুকু ঐকান্তিকতা দিয়ে এই কাজটি করবো। এই আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি করতে হলে ইনশাআল্লাহ্‌ বলার অভ্যাসের সাথে সাথে পরিস্থিতির বাস্তবতায় ‘না’ বলার হিম্মত, সাহস ও যোগ্যতা অর্জন বাঞ্চনীয়। একজন মুসলমান সবসময় কোমল, বিনয়ী, ভদ্র হবে নিশ্চয়ই, একই সাথে স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড হওয়াটাও তার নৈতিক গুণ।


প্র্যাকটিক্যাল মুসলমান হিসেবে একটি কথা খুব সহজভাবে কবুল করে নিতে হবে যে- ‘না’ বলা মানেই অসৌজন্যতা, অসম্মান, অশ্রদ্ধা ও আনুগত্যহীনতা নয়। ইনশাআল্লাহ্‌র অপব্যবহার বন্ধ করতে বিনম্র ‘না’ মুসলিম মানসে অবশ্যই খুব স্বাভাবিকভাবে প্রোথিত হতে হবে। আমরা এখন ইনশাআল্লাহ্‌র পরিবর্তে ‘না’ বলার ৩ টি কৌশল আলোচনা করবো।


সময়ক্ষেপণ কৌশলঃ আপনার প্রিয়তম বন্ধু আগামীকাল দুপুরে তার সন্তানের আকিকা উপলক্ষে লাঞ্চের দাওয়াত দিল। সম্পর্কের গভীরতায় না বলা কঠিন, আবার অফিস টাইমে ছুটিও পাওয়া কঠিন। পরিস্থিতি সামলে নিতে ফোনে ইনশাআল্লাহ্‌ না বলে বিনয়ের সাথে বলি- অফিসে বসের সাথে কথা বলে তোমাকে জানাতে পারলে আমার জন্য এহসান হতো। অর্থাৎ কাউকে তাৎক্ষনিক ইনশাআল্লাহ্‌ বলার চেয়ে একটু সময় নিয়ে ফিডব্যাক দিই। তাহলে অগ্র-পশ্চাৎ অনেককিছু ভেবে প্র্যাকটিক্যাল সিদ্ধান্ত দিতে পারবো। অভ্যাসবশত ইনশাআল্লাহ্‌ না বলে সচেতনভাবে ইনশাআল্লাহ্‌ বলি। সরাসরি কারো মুখের উপর না বলতে না পারলে সিদ্ধান্তের ব্যাপারে একটু বিলম্ব করি। তাতে প্রতিশ্রুতি গ্রাহক বাস্তবতা কবুল করার ফুসরৎ পাবেন; একই সাথে আমিও সচেতনভাবে ইনশাআল্লাহ্‌/ না বলার সুযোগ পাবো।


প্রতিস্থাপন কৌশলঃ অফিসের বস একেবারে নতুন এক প্রজেক্টে আমাকে পাঠাতে চাইছে। খুব স্বভবতই আমরা সেখানে যেতে চাইবো না। নতুন প্রজেক্ট সম্পর্কে অনভিজ্ঞতা এবং নতুন কর্মক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জ নিশ্চয় ভীতির সৃষ্টি করবে। বসের নির্দেশের মুখে অনিচ্ছা স্বত্বেও ইনশাআল্লাহ্‌ না পড়ে নিজের সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করবো। বলতে পারি- আমি সম্ভবত এই নতুন প্রজেক্টের জন্যে পারফেক্ট নই। কারণ............। সুযোগ থাকলে সহকর্মীদের মধ্যে স্পেশালিষ্ট কাউকে সাজেস্ট করবো।


ঠিক এভাবে উর্ধ্বতন কারো নির্দেশনাকে সরাসরি না বলতে পারলে আশেপাশের বিকল্প সমাধান উপস্থাপন করা যেতে পারে। আর পরিস্থিতি সামলে নেয়ার সুযোগ থাকলে বিনয়ের সাথে নিজের অনিচ্ছার কথা স্বীকার করাটা অধিক কল্যানের। তবে একজন মুসলমান কখনো কথা চেপে রেখে বাধ্য হয়ে ইনশাআল্লাহ্‌ বলে পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট কাজে গাফলতি ও অনাগ্রহ প্রদর্শন করতে পারেন না। ইনশাআল্লাহ্‌ বলার অর্থই হচ্ছে- সর্বোচ্চ মনোযোগ ও প্রচেষ্টা। কোন কাজ পছন্দসই না হলে বলা যেতে পারে ‘আমি চেষ্টা করছি’; তবে কোনভাবেই ইনশাআল্লাহ্‌ নয়।


সংকোচন কৌশলঃ প্রফেশনাল একটি মিটিং এ আমাকে ইনভাইট করা হলো। ৩ ঘন্টাব্যাপী মিটিংয়ে আমার সাথে রিলেটেড আলোচনা ৩০ মিনিট। আমার অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে অযথা ৩ ঘন্টা মিটিংয়ে বসে থাকার যৌক্তিকতা নেই। এমতাবস্থায় ইনভাইটরকে ইনশাআল্লাহ্‌ না বলে বলবো- আমি মিটিংয়ের এই শেষনে থাকতে চাই; কারন শেষনটি আমার জন্যে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ পুরো ইনশাআল্লাহ্‌র অর্থ যেন বিকৃত না হয়। কাউকে যখন প্রতিশ্রুতি দিব, তখন ইনশাআল্লাহ্‌, ইনশাআল্লাহ্‌ না বলে সুনির্দিষ্ট কথা বলে প্রতিশ্রুতিকে সংকোচিত/লাঘব করা যেতে পারে।


না বলা কঠিন কিছু নয়। কিছুদিন অনুশীলন করতে পারলেই এটি সহজাত গুণ হয়ে উঠবে। সত্যি বলতে কি ইনশাআল্লাহ্‌ বলে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার চেয়ে না বলার মহৎ গুণকে সকলে স্বাগত জানাবে এবং যে কারো ব্যক্তিত্বের পরিচ্ছন্নতাকে প্রকাশ করবে।


কিভাবে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অধীনস্তদের ইনশাআল্লাহ্‌র উপর দণ্ডায়মান রাখতে পারেন?
ব্যক্তি উদ্যোগে ইনশাআল্লাহ্‌র সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত এবং তার ব্রান্ডিং করার প্রচেষ্টা খুব কমই প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। তাহলে কিভাবে ইনশাআল্লাহ্‌র ব্রান্ডিং হবে? কিভাবে ইনশাআল্লাহ্‌র মর্যাদা অটুট থাকবে? এখন আমরা সেটিই বলবো। ব্যক্তির চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক/সাংগঠনিকভাবে ইনশাআল্লাহ্‌র স্ট্যাটাস বজায় রাখার অনুশীলন করলে তা একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিবে। বিশেষ করে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইনশাআল্লাহ্‌র সঠিক চর্চা নিশ্চিত এবং অপব্যবহার রোধ করতে হবে। প্রতিষ্ঠান/সংগঠনের উর্ধ্বতনদের পক্ষ থেকে পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ইনশাআল্লাহ/না উভয় অপশন খোলা রাখতে হবে। 
একঃ ইনশাআল্লাহ্‌র ব্যাপারে সবাইকে প্রকৃত শিক্ষা দেয়া দরকার। অফিস, সংগঠনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবশ্যই অধীনস্তদের ইনশাআল্লাহ্‌র প্রকৃত হক ও দাবী শিক্ষা দিবেন। ইনশাআল্লাহ্‌ বলার অর্থ কি তা না জানলে গণহারে ইনশাআল্লাহ্‌ বলা অব্যাহত থাকবে আর প্রতিশ্রুতি ভাঙ্গতেই থাকবে। ইনশাআল্লাহ্‌র অপব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করা দরকার। বুঝানো দরকার ইনশাআল্লাহ্‌র সঠিক ব্যবহারের নৈতিক দায়বদ্ধতার পাশাপাশি তার অপব্যবহারে ব্যক্তিত্বর চারিত্রিক ত্রুটি দৃশ্যমান হয় এবং প্রতিষ্ঠান/সংগঠনের প্রোডাক্টিভিটি ক্ষুণ্ন হয়। উর্ধ্বতনরা ইনশাআল্লাহ্‌র অপব্যবহার দেখলে অধীনস্তদের অবশ্যই ফিডব্যাক দিবেন। প্রয়োজনে ইনশাআল্লাহর অপব্যবহারকারীকে শাস্তি এবং সঠিক ব্যবহারকারীকে পুরস্কিত করা যেতে পারে।
দুইঃ উর্ধ্বতনদের পক্ষ থেকে অধীনস্তদের না বলার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। অনেক প্রতিষ্ঠানে ‘না’ বলার অর্থ হচ্ছে ‘ক্যারিয়ার সুইসাইড’ করা। সংগঠনের নেতাদের মুখে না করার অর্থ ‘আনুগত্যহীন’ বলে বিবেচিত হওয়া। অধীনস্তদের এই চাপ থেকে মুক্তি দিতে হবে। ‘ না’ বলা ইনশাআল্লাহ্‌ বলে মিথ্যাচারের চেয়ে উত্তম।


শেষকথাঃ 
ইনশাআল্লাহ্‌ সত্যিই এক দারুণ শব্দ। জেনেবুঝে ইনশাআল্লাহ্‌ বলার মাধ্যমে কর্মসম্পাদনকামী বান্দা ও তার প্রভূর মাঝে এক ধরনের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বন্ধন তৈরী হয়। এই স্পিরিট কর্মসম্পাদনে দায়বদ্ধতা এনে দেয়। কুরাআনুল কারীমের মাধ্যমে নাযিলকৃত এই পবিত্র শব্দের অপব্যবহার একদিকে আমাদের ব্যক্তি হিসেবে ক্ষতিগ্রস্থ করে, অপরদিকে মুসলিম ব্রান্ডে সজোরে আঘাত হানে। আমরা সীমাবদ্ধতা নিয়ে ‘আল ইসলাম’ এর বড় কোন খেদমত করতে না পারলেও ইনশাআল্লাহ্‌র মুসলিম ব্র্যান্ডিংয়ের গায়ে কোন কালিমা লাগানো থেকে অন্তত হেফাজত করতে তো পারি। আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন। 
তথ্যসূত্রঃ 
• আল কুরআনঃ সূরা কাহফ- ২৩/২৪
• তাফসীরে ইবনে কাছীর- সূরা কাহাফের পটভূমি
• তাফসীরে মা’আরেফুল কুরআন- সূরা কাহফের পটভূমি
http://www.produvtivemuslim.com- An article on Let’s restore the dignity of InshaAllah
• নিউইয়র্ক টাইমস – An article on InshaAllah is good for everyone. 
• মাসিক আল কাউসার- এপ্রিল ২০১২ সংখ্যা


0 comments:

Post a Comment