Saturday, December 31, 2016

জামায়াত সংস্কারঃ কিছু কথা (দ্বিতীয় পর্ব:)

জামায়াতের দর্শনগত হীনমন্যতা এবং রাজনৈতিক অস্পষ্টতা

ধরুন- ২০১৭ সালের জানুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ১৫১ আসনের অধিক পেয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সমাসীন হলো। এবার বলুন কোন কোন কাজ অগ্রাধীকার পাওয়া উচিৎ? নিজে একটা তালিকা করুন আর আরেকজনকে ঠিক একই প্রশ্ন করুন। আমি নিশ্চিত তালিকা ভিন্ন ভিন্ন হবে। কেন এমন হবে? এর কারণ হচ্ছে- জামায়াত রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে কি কি ইনিশিয়েটিভ নিবে, তার কোন একাডেমিক ও লিটারাল ডকুমেন্টস আদৌ তৈরী করে নি। কর্মীরাও জানে না- আসলে কোন ধরনের রাষ্ট্র কাঠামোর জন্যে তারা জাহেলিয়াতের সাথে লড়াই করে চলছেন।

পাঁচজন জামায়াত কর্মীকে যদি প্রশ্ন করা হয়- আপনারা আসলে কোন ধরনের রাষ্ট্র গঠন করতে চান? খেয়াল করলে দেখবেন একটি কমন উত্তর আসবে- ''ইসলামের ইনসাফপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা''। এরপরের প্রশ্ন যদি হয় সেই 'ইনসাফপূর্ণ' রাষ্ট্রের চিত্র কেমন ? দেখবেন একেকজন একেক রকমের উত্তর দিচ্ছে। রাষ্ট্রের আপামর নাগরিকদের তো নয়ই; আদতে জামায়াত তার জনশক্তিদেরও তার প্রত্যাশিত রাষ্ট্রব্যবস্থার ছবি আঁকিয়ে দেখাতে পারে নি। জামায়াত ক্ষমতায় গেলে যুবকদের জন্য কি কি উদ্যোগ গ্রহণ করবে? মোটাদাগে বলবেন- কর্মসংস্থানের সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়া হবে। কিন্তু বাংলাদেশের যুবকরা কি জানে জামায়াত ক্ষমতাসীন হলে তারা কিভাবে উপকৃত হবে? শ্রমিকরা কি জানে- তারা কিভাবে ইনসাফের সুফল পাবে? পতিতারা কি জানে- কিভাবে তাদের গ্লানিময় লাঞ্চনার জীবনের অবসান করবে জামায়াত? চোর-ডাকাতরা কি জানে- কিভাবে তাদের সমাজে পূনর্বাসন করে দেয়া হবে? দরিদ্র মানুষগুলোকে কিভাবে ক্ষুধামুক্ত করা হবে, আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে-সেটি কোথায় বিব্রত হয়েছে? কৃষকরা কি জানে কিভাবে তাদের উৎপাদিত ফসলের নায্য মুল্য নিশ্চিত করা হবে? ভোক্তারা কি জানে কিভাবে তাদের ক্রয়কৃত পণ্যমাণ নিশ্চিত করা হবে? জামায়াত ক্ষমতায় এলে নারীদের ঘরে বন্দী করে ফেলা যে অভিযোগের তীর ছোঁড়া হয়, তার বিপরীতে জামায়াত কিভাবে নারীদের সমাজে কন্ট্রিবিউট করাবে তার একাডেমিক বয়ান কোথায় আছে? জাহেলী সংস্কৃতির বিপরীতে কিভাবে ইসলামী সংস্কৃতিকে রিপ্রেজেন্ট করা হবে?

এসবের প্রশ্নের উত্তরে আপনি চিরায়ত ভঙ্গিতে বলবেন- কেন মদীনার ইসলামী রাষ্ট্র কি উদাহরণ হিসেবে সামনে নেই? আমি বলি, হ্যাঁ আছে। প্রথম কথা হলো- মদীনার সেই রাষ্ট্রের কাঠামো কয়জন নাগরিক জানে? দ্বিতীয়তঃ সময়ের ব্যবধানে এমন কিছু ইভেন্ট তৈরী হয়েছে, যার কোন বাস্তব উদাহরণ মদীনায় ছিল না। যেমনঃ অনলাইন দুনিয়া। এই সময়ে এসে অবশ্যই রাষ্ট্রের নাগরিকদের সামনে জামায়াতের ইনসাফপূর্ণ রাষ্ট্রের কাঠামো পরিস্কারভাবে তুলে ধরা দরকার। সেই কাঠামো দেখে নাগরিকরা সমর্থন করবে কি করবে না- সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। নিদেনপক্ষে কোন আদর্শের কর্মীদের সেই স্বপ্নের রাষ্ট্রব্যবস্থার একটা মডেল ছবি হৃদয়ে প্রোথিত করে দিতে হবে? আমি বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করি- জামায়াত যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই করছে, সেই রাষ্ট্রের ফ্রেম কোথায়? না কি আজতক আদৌ সেই ফ্রেম তৈরীই করা হয় নি। শুধু শুধু মোটাদাগে এক 'ইনসাফপূর্ণ রাষ্টব্যবস্থা'র ভৌত কাঠামোর ছায়ার পেছনে ছুটছে? সমর্থক কিম্বা বিরোধী সকলের কাছেই সেই ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের একটা ছবি তৈরি করে দিতে হবে। জামায়াতের কর্মী ও সমর্থকরা আদৌ জানেই না, জামায়াত ক্ষমতাসীন হলে কোন ৫ টি কাজ প্রথমে করবে, তারপরে কোন ৫ টি কাজ, তারপরে কি কি? তারমানে এক অজানা কর্মসূচীর পথে লাখো কর্মী ছুটে চলছে।

এই আলোচনায় প্রশ্ন উঠতে পারে- ইসলামী দল হিসেবে কেন নাগরিকদের সামনে ভবিষ্যত রাষ্ট্রের কাঠামো দাঁড় করানোকেই আমি এত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছি? উত্তরে বলি- জামায়াত যেহেতু নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেই আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ (অবশ্যই চূড়ান্ত ধাপ নয়) বিবেচনা করে, তখন জনগণের সামনে আপনার কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরাটা অতি জরুরী একটা ইস্যু। কেন জনগণ আপনাকে ক্ষমতার চেয়ারে বসাবে? আপনি সৎ, দূর্নীতিমুক্ত, সত্যবাদী- শুধু এ কারনেই? আপনি ছাড়াও সৎ, দূর্নীতিমুক্ত, সত্যবাদী মানুষ তো আছে। জনগণের সমর্থন পেতে হলে- এক সুস্পষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা ও মেনিফেস্টো দাঁড় করাতে হবে। সেটা নিয়ে মানুষকে কনভিন্সের দিকে যেতে হবে। মোটাদাগে কথা বললে চলবে না। ছাত্র-যুবক, বৃদ্ধ, পুরুষ-নারী, শ্রমিক-মজুর-কুলি, কৃষক, মুর্খ-শিক্ষিত, বেকার, চোর-ডাকাত, পতিতা, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিল, শিল্পী, বাউন্ডুলে- সকলের জন্য প্যাকেজ ঘোষনা করতে হবে। ক্ষমতায় আসলে সব অটো হয়ে যাবে- ধারনা যতদিন থাকবে, ততদিন ক্ষমতায় বসার সুযোগ নাও হতে পারে।

জামায়াত নিয়ে একটা বড় সমালোচনা আছে। তা হলো- জামায়াত নিজেদের মত করে, নিজেদের অভ্যন্তরে, নিজেদের পরিসরে অনিন্দ্য সুন্দর। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মানুষ জামায়াতের অনুপম আদর্শ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। বাঁকি ৯০ শতাংশ মানুষ জামায়াতকে না জেনে জঘন্য খারাপ ভেবে বসে আছে। সত্যি বলতে কি- জামায়াত এমন কোন ইনিশিয়েটিভ নিতে পারেনি, যা বৃহৎ জনগোষ্ঠির কাছে জামায়াতেকে পজেটিভলি রিপ্রেজেন্ট করবে। জামায়াতের নেতৃত্ব সৎ, দেশপ্রেমিক ও নির্লোভ- এই তথ্যগুলো জামায়াতের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত বলে আমরা ধরেই নিই সবাই বুঝি এমনই ভাবছে। জামায়াতের নেতৃত্ব বাছাইয়ের প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা যতটা উচ্ছ্বসিত ও সন্তোষ্ট- তা আদৌ সাধারণ নাগরিকদের ছুঁয়ে দিতে পারে না ( সুযোগও নেই)। সংগঠনের অভ্যন্তরে অসাধারণ গনতন্ত্রের চর্চা নিয়ে নাগরিকদের জানারও সুযোগ নেই। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত কতটা ইন্ট্রোভাট (অন্তর্মুখী), তা খোলা চোখে দেখার সময় এসেছে। এটা তো সত্য ব্যবসা, চাকুরী, বিয়ে, সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা একটা নিজস্ব জগত তৈরী করে ফেলেছি। যেখানে অন্য কারো এক্সেস একেবারেই সীমিত। অথচ আল ইসলামের শ্বাশ্বত সার্বজনীনিতাকে আমরা একাডেমিক্যালি অনেক বেশী হাইলাইটস করি।

এবার দর্শনগত একটা বড় গলদ নিয়ে কথা বলার ঝুঁকি নিচ্ছি। ঝুঁকি এই অর্থে বলছি- এটা আমার ব্যক্তিগত ভাবনা। আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি। প্রত্যেকটি ইসলামী দল দাবী করে রাসূল সাঃ এর সেই ইসলামী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ধরে আজ আমরা সংগঠনে সংঘবদ্ধ। এখানে একটা সূক্ষ্ম ব্যাপার আছে। রাসূল সাঃ এর ইসলামী আন্দোলন শুধুমাত্র আল ইসলাম ছিল। অন্য কোন দল, সংগঠন ছিল না। রাসূল সাঃ একমাত্র নেতা এবং তার নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ ছিল। এক জামায়াত- আল ইসলাম। কিন্তু এখন একই জনপদে অনেক ইসলামী সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেকেই তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতে বিশ্বাসী। সকলেই আল্লাহকে রব বলে, রাসূল সাঃ কে নেতা বলে মেনে নিয়েছে। প্রত্যকেই দাবী করে তারা রাসূলের সেই আদর্শের পতাকাবাহী। প্রত্যেকের দাবিই সত্য বলে ধরে নিয়ে আল ইসলামের জন্য সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করছেন বলে সফটলি ভাবার সুযোগ আছে। কিন্তু আল ইসলামের ''লা তাফাররাকু'' তাতে কতটা অক্ষুণ্ণ থাকে তা নিয়েও ভাবনার দুয়ার খোলা রাখতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে উপলব্ধি করি- আল ইসলামে কোন দল, সংগঠন নেই। সবাই মিলে আল ইসলামের পতাকাবাহী। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে- তাহলে জামায়াত কি দল হিসেবে ''লা তাফাররাকু'' ভায়োলেট করছে? 'জামায়াতে ইসলামী' নামে দলের অস্তিত্ব মানেই অন্যান্য ইসলামী দলের মাঝে এক বিভাজন তৈরী হয়ে যাচ্ছে কি? আমি বলি- না। মোটেই তা না। তবে এই জায়গাতে একটু কারেকশন আছে। জামায়াত মানেই বুঝতে হবে আল ইসলামের বটবৃক্ষ। আল ইসলামের ভেতরে কেউ অর্থনীতি নিয়ে কাজ করবে, কেউ সংস্কৃতি নিয়ে, কেউ শিক্ষা নিয়ে, কেউ ব্যবসা নিয়ে, কেউ তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে। ঠিক এভাবেই কেউ রাজনীতি নিয়ে কাজ করবে। ''রাজনীতি ও আল ইসলাম'' দুটোই হুবহু এক জিনিস- এই দর্শন নিয়ে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে। আমি স্পষ্টতঃ একটা কথা বুঝি- আল ইসলামের কোন দল নেই- তবে ইসলামী অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতির মত রাজনীতিও একটা বড় ক্ষেত্র। জামায়াতকে আল ইসলামের পতাকাবাহী করে গড়ে তোলা অপরিহার্য। সেই আল ইসলামের পতাকাবাহী জামায়াতের একটা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থাকতে পারে ( এবং অবশ্যই থাকতে হবে।)। জামায়াত সকল সেক্টরের মাদার অর্গানাইজেশন। জামায়াতের শিক্ষা সংগঠন, ব্যবসায়িক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, অর্থনৈতিক সংগঠনের সাথে সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ন রাজনৈতিক সংগঠনও থাকবে।

সমস্যা হলো- এখন এই রাজনৈতিক সংগঠনই 'বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী' কি না? এটা নিয়ে ডিবেট আছে। রাজনৈতিক সংগঠনের অধীনেই সকল অন্যান্য সংগঠন নিয়ন্ত্রনাধীন কি না? উত্তর দেয়া যতটা কঠিন, আবার ততটাই সোজা। এখন জামায়াতকে তার দর্শন সুনির্দিষ্ট করাটা অত্যাবশ্যক। জামায়াতকে মাদার সংগঠন হিসেবে রিপ্রেজেন্ট করতে পারলে ইন্সট্যান্ট দুটি লাভ।
একঃ
সকল ইসলামী একটিভিজমের কেন্দ্রবিন্দু হবে মাদার সংগঠন। অন্যান্য ইসলামী দলকেও পেট্রোনাইজ ও অভিভাকত্ব করার একটা স্পেস তৈরী হবে।
দুইঃ
এখন যত সমালোচনা ও কথা হচ্ছে- তা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম নিয়ে। যার দায় কোনভাবেই আল ইসলাম নিতে পারে না। আর মানুষের নেতৃত্ব নিয়ে সব সময়ই কথা ও সমালোচনা হতেই থাকবে। রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের কর্মসূচির দায় তখন কেবমমাত্র রাজনৈতিক উইং ই বহন করবে।

বাংলাদেশে জামায়াতের এক অমিত সম্ভাবনা আছে। একদল জানবাজ, যোগ্যতা সম্পন্ন, নির্ভিক, মেধাবী জনগোষ্ঠি ইসলামী আন্দোলনের সাথে নিজেদের জীবনকে মিলিয়ে নিয়েছে। তরুণ প্রজন্মের বিশাল একটা অংশ ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত। এসব আমানতকে যোগ্যতার সাথে ব্যবহার করা নেতৃত্বের দায়িত্ব ও কর্তব্য। বলা হয়ে থাকে- ''ইসলামী আন্দোলনের বিজয়ী হলো কি না তা গৌণ বিষয়, ব্যক্তি হিসেবে আমি জান্নাত পেলাম কি না- সেটিই মুখ্য বিষয়।'' এই কথাটি সাধারণ কর্মীদের জন্য প্রযোজ্য। কেয়ামতের দিন নেতৃত্বকে অবশ্যই ইসলামী আদর্শকে অন্যান্য আদর্শের উপর বিজয়ী করার ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। আল্লাহ্‌র রাসূল এই জমীনে এসেছিলেনঃ

"আল্লাহই তো সে মহান সত্তা যিনি তাঁর রসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন দিয়ে পাঠিয়েছেন যেন তাকে সমস্ত দ্বীনের ওপর বিজয়ী করে দেন। আর এ বাস্তবতা সম্পর্কে আল্লাহর সাক্ষই যথেষ্ট।" (সূরা ফাতহঃ ৪৮ঃ২৮)

Monday, December 19, 2016

জামায়াত সংস্কারঃ কিছু কথা

এক, 
গত কয়েক মাস ধরে 'জামায়াত সংস্কার'- শিরোনামে তুমুল কথা হচ্ছে। সত্য এটাই যে প্রচুর কথা হচ্ছে। নিরেট সাংগঠনিক জনশক্তিরা সংগঠনের অভ্যন্তরে, সংগঠনের সাহিত্যপ্রেমী ও লেখালেখি প্রিয় জনশক্তি অনলাইনে এবং জামায়াতে বিরোধী বলয় তাদের মোক্ষম অস্ত্র মিডিয়াতে জামায়াত সংস্কার নিয়ে কথা বলছে। ঝড়ের সময়ে বালুর নিচে মুখ লুকিয়ে যতই বলা হোক- ঝড় বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব নেই, তাতে ঝড় থামে না। ঝড় শেষে মুখ তুলে দেখতে হয়- অনেককিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। বিচক্ষনরা ঝড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রয়োজনীয় জিনিসকে সাহসের সাথে হেফাজত করে। আমি অনেক ভেবেই এ বিষয়ে কিছু কথা বলার ইচ্ছে পোষণ করছি। একজন তৃণমূলের কর্মী কিভাবে জামায়াতকে নিয়ে ভাবে, কিভাবে আকাংখা করে, কিভাবে কষ্ট পায়- তা উর্ধতনদের জানা দরকার। আমার এ লিখাই একজন তৃণমূলের কর্মীর হাহাকার থাকবে, অনেক ভুল ধারনা উপস্থাপিত হবে। আমি চাই- শীর্ষ নেতৃত্ব জানুক, কর্মীরা কি কি ভুলের মাঝে আছে। এর মাধ্যমে হয়তো কর্মীরা সঠিক তথ্য পাওয়ার একটা মওকা পাবে। ।




দুই, 
যারা এতটুকু পড়েই আমাকে সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙ্গের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইছেন, তাদেরকে আমার কিছু বলার নেই। শুধু বলবো- কাঠগড়াতে উঠানোর আগে অন্তত কষ্ট করে আমার এই বিশৃঙ্খল চিন্তা্গুলো একবার জেনে নিন। তাতে ভবিষ্যতে অনেককে কাঠগড়ায় তোলা থেকে বেঁচে যাবেন। আবার কেউ কেউ ভেবে বসবেন- কেন অনলাইনে লিখছি। শীর্ষ নেতৃত্বকে কি অন্যভাবে কথাগুলো বলা যেতো না? উত্তরে বলি- হ্যাঁ, যেতো। তাতে নেতৃত্ব পাবলিক রিএকশ্যন জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতেন। এখন আমার এই লিখাগুলোকে যেভাবে ইচ্ছে নিতে পারেন।



(প্রথম পর্ব:) 
মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদীর মহাসংস্কারঃ তারপরের নেতৃত্বের স্থবিরতা-




উপমহাদেশে 'মোকছেদুল মোমেনীন' অথবা 'ফাজায়েলে আমল' মার্কা নিরামিষ ইসলামের ভরা জোয়ারের মাঝে চল্লিশের দশকে সর্বপ্রথম 'জীবন ব্যবস্থা' হিসেবে এক বৈপ্লবিক ইসলামের প্রানস্ত্বাকে তুলে ধরলেন সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী (রঃ)। এ এক অনন্য সংস্কার। ইসলাম যে কেবলমাত্র 'ধর্ম' পরিচয়ে প্রকৃতভাবে উপস্থাপিত হয় না, বরং এটি ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল স্তরের গাইড- তা সম্ভবত ভারতীয় উপমহাদেশের আবুল আলা'ই এই সাব-কন্টিনেন্টে প্রথম একাডেমিক ও প্র্যাক্টিক্যালী প্রমাণে সচেষ্ট হোন। চল্লিশের দশকের আগে এই উপমহাদেশে ইসলামের কোন দর্শন ছিল না; স্রেফ সুফী-সাধকের বাউন্ডলেপনা আর সাধারণ মুসলমানের আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্ম ছিল। মাওলানা মওদূদী ধর্ম হিসেবে প্রচলিত ধারণার মূলোৎপাটন করে এক রেভ্যুলুশনারী সিস্টেম হিসেবে ইসলামের দর্শন জনতার সামনে উপস্থাপন করলেন। কল্পনা করতে পারেন- দর্শন ডিফাইন করাটা কত বড় কঠিন ও ঝুঁকির কাজ? কত বড় সংস্কার কর্মসূচী? মাওলানা তৎকালীন পাকিস্তানের নেতাদের খেয়ালীপনা ইসলামিক বিপ্লবের আকাস-কুসুম কল্পনার অন্তঃসারশূন্যতা তুলে ধরেছিলেন। ওনি সবার মত করে ভাবেন নি। সবাই এক জোয়ারের দিকে ছুটেছেন আর তিনি সেই জোয়ারের বিপরীতে হেঁটেছেন। ভারত ভাগ করে পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম করে যারা ইসলামের বিজয় কেতন উড়িয়ে জয়োল্লাস করেছিলেন, মাত্র ৩৪ বছরে তারাই জুলুম-নির্যাতন করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হয়ে ওঠার ভিত্তি গড়ে দিলেন। দিল্লীর তাঁবেদারি থেকে মুক্ত করার পর নিজেরাই ইসলামাবাদে তাঁবেদার সেজে বসলেন। মাওলানা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ইসলামের বিপ্লবের পদ্ধতি নিয়ে যা বলেছিলেন- বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাধ্যমে সেটিই দারুণভাবে প্রমাণিত হয়েছিল। আমগাছ থেকে জাম ফল আশা করা যায় না। মাওলানা এভাবেই প্রজ্ঞার সাথে কথা বলতেন। 




মাওলানা মওদুদী 'ইসলামী বিপ্লবের পথ' বাতলে দিয়ে একটা বক্তৃতা দিলেন ( পরের আলোচনার সুবিধার্তে একটা নোট নিয়ে রাখুন- এটা একটা বক্তব্য, যা এখন বই আকারে আমরা পড়ি)। আন্দোলনের সফলতার কিছু শর্ত নির্ধারণ করে দিলেন। লিখালিখির মাধ্যমে পলিটিক্যাল ইসলামের দর্শনের একটা বিস্তারিত রূপরেখা তুলে ধরলেন। আপনি একবার ভেবে দেখুন- কি নিয়ে ওনি লিখেন নি। অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, রাজনীতি, শিল্প, সংস্কৃতি, ব্যবসা, ইবাদাত, সরকার পদ্ধতি, তুলনামূলক ধর্মতত্ত সহ চলমান প্রৃথিবীর প্রায় সব ইস্যুতে ওনি নিদারুন কষ্ট করে লিখলেন। একাডেমিক্যালি 'জীবন ব্যবস্থা' ইসলামের চেহারা তুলে ধরলেন। মানুষ উদ্বেলিত হলো। দলে দলে মানুষ এই দর্শনে প্রভাবিত হলো। পাকিস্তান থেকে উপমহাদেশ ছড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে পৃথিবীব্যাপী সে আলোর মশাল বিস্তৃত হলো। সমকালীন সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে হাসানুল বান্নার ইখওয়ান যেন আপন ভাই হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে পেয়ে গেল। তুমুল বেগে ঢেউ উঠলো মুসলিম মানসে। 






আজ ২০১৬ সাল। মাওলানা মওদূদী (রঃ) ইন্তেকাল করলেন ১৯৭৯ সালে। এক যুগ সংস্কারক ঘুমিয়ে গেলেন। অত্যন্ত দূঃখের সাথে বলতে হয়- তার কবরের সাথে সংস্কার কর্মসূচীও ঘুমিয়ে গেল। অনেকে অভিযোগ তোলেন- জামায়াত মওদূদীবাদী। আমরা যারা সংগঠনের কর্মী তারা জানি- জামায়াত ব্যক্তি মওদুদীকে নিয়ে এতটুকুও কনসার্ন নয়। 'উসওয়াতুন হাসানা' রাসূল সাঃ ই আমাদের একমাত্র আদর্শ। এখন আমি কিছু ব্যাপারে আমি প্রশ্ন তুলতে চাই।

(ক)
'ইসলামী বিপ্লবের পথ'- বক্তব্য (যা এখন বই) কি ২০১৬ সালে এসেও খুব বেশী প্রাসঙ্গিক? ইসলামী বিপ্লবের পথ বইয়ে যেভাবে বিপ্লবের পথ বাতলে দেয়া হয়েছে, সেটি ৬৮ বছর পরেও হুবহু প্রাসঙ্গিক কি না? জেনে রাখুন- মাওলানা যেসময় এই বক্তব্য দিয়েছেন, তখন রাষ্ট্র-কাঠামো এভাবে ছিল না। আর বক্তব্য কি কয়েক দশক পরের বাস্তবতাকে সামনে রেখে দেয়া হয়? না কি তৎকালীন বাস্তবতার আলোকে সেসময়ের জনশক্তিদের করণীয় হিসেবে দেয়া হয়? আমি ধরে নিলাম- বিপ্লবের পথ বক্তব্যের অনেক কিছুই কেয়ামত পর্যন্ত একই থাকবে; কিন্তু নিশ্চয় একমত হবে সবকিছু অপরিপর্তিত নেই। বর্তমান সময়ে বিপ্লবের জন্য আরো কিছু ইস্যুতে হাত দিতে হবে। সেটি ঐ বইয়ে বাতলে দেয়া হয় নি। অথচ এখনো জনশক্তিদের ঐ বইকে ঠোতস্থ করতে হয়। আমি বলি- অতীতের বাতলে দেয়া পথ এখনকার জনশক্তিদের জন্য খুব বেশী প্রাসঙ্গিক নয়। ইসলামী বিপ্লবের সেই বাতলে পথের সাথে এখন সংযোজন/ বিয়োজন অপরিহার্য। কেউ কি কখনো এসব ভাবছেন? 




(খ)
ইসলামী আন্দোলনঃ সাফল্যের শর্তাবলী বইয়ে একটি ইসলামী আন্দোলনকে সফল করার জন্যে বেশ কিছু শর্ত নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বইটি চল্লিশের দশকে লিখা। আমি বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করছি- ২০১৬ সালে এসেও কি সেই শর্তগুলোই প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে? এই ৬০/৭০ বছরে কোন শর্ত যুক্ত হয় নি। কোন চ্যালেঞ্জ নতুন করে আসে নি? সমাজব্যস্থার ধরন ও কাঠামোর কোন পরিবর্তন হয় নি? কেউ কি এই ৭০ বছরে নতুন কোন শর্ত যুক্ত করে দিতে পারলো না? 




(গ) চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান বইয়ে চরিত্র গঠনের জন্য নঈম সিদ্দিকী কিছু মৌলিক উপাদানের কথা বলেছেন। আমি বিনয়ের বলি- আধুনিক জাহেলিয়াতের এই ভরা যৌবনে চরিত্র গঠনের জন্য চল্লিশের দশকে বাতলে দেয়া নঈম সিদ্দিকী বর্ণিত ৪ টি গুনাবলীই কি কালজয়ী? আচ্ছা নঈম সিদ্দিকী কি সেই সময়ে অনলাইন জাহেলিয়াতের কথা জানতেন? একজন প্রতিটি ঘরে ভার্চুয়াল পতিতালয় আছে-তা কি ওনি মাথায় রেখেই চরিত্র গঠনের উপাদানগুলি বর্ণনা করেছিলেন? নতুন কোন উপাদান কি চরিত্র গঠনে প্রয়োজন নেই? 




আমি মাত্র তিনটি বইয়ের ফুটনোট দিলাম। এভাবে অনেকগুলো বইয়ের নোট দেয়া যায়। যে মহাবিপ্লবী, মহাসংস্কারক এক নিরামিশ পরিবেশে ইসলামের বৈপ্লবিক উত্তাল তরঙ্গকে এনে দিলেন, মৃত্যুর সাথে সাথে সেই সংস্কার প্রক্রিয়া থেমে গেল। আমি মনে করি- মাওলানা সেই তখন সময়োপযোগী সংস্কারই করে দিয়ে গেছেন। আমরা কেন সেখানেই পড়ে আছি? কেন বিপ্লবের পথ নিয়ে চিন্তাধারা থমকে আছে? কেন বিপ্লবে সাফল্যের শর্ত নিয়ে ভাবা হচ্ছে না? কেন চরিত্র গঠনের নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সলিউশ্যুন দেয়া হচ্ছে না? জানি না, আমি ভুল ভাবছি না। মাওলানা মওদূদীর এসব একাডেমিক ডেফিনিশনের সম্পূরক লিখনি কি আদৌ প্রয়োজন আছে বলে কি বর্তমান নেতৃত্ব ভাবছে? আমি কম জানাশোনার লোক। হয়তো এসবের আদৌ কোন প্রয়োজন নেই। মাওলানা যা বলে গেছেন- তা ই যথেষ্ট। এখন শুধু কাজ করে যেতে হবে। অথবা হয়তো ইতোমধ্যেই সম্পুরক একাডেমিক সংযুক্তি হয়েছে। আমি সবিনয়ে জানতে চাই- সেগুলোর তালিকা কি পেতে পারি?

এ ব্যাপারে আমার একটা দুঃখবোধ আছে। মাওলানার একাডেমিক সংস্কারের বর্তমান সংস্করণের জন্য বেশী যোগ্য ছিলেন মরহুম প্রফেসর গোলাম আযম, মরহুম মাওলানা আব্দুর রহীম (রঃ) এবং মরহুম মাওলানা আব্বাস আলী খান (রঃ)। আমার জানামতে মাওলানা বর্নিত ইস্যুগুলোতে ওনারাও কোন হাত দেন নি। নতুন অনেক বিষয়ে লিখেছেন, তবে মৌলিক কিছু বিষয় অক্ষতই রয়ে গেছে। মাওলানা পরবর্তী নেতৃত্ব কেবল কর্মসূচী নিয়ে কাজ করেছে; দর্শনগত মৌলিক ইস্যুকে সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছে। একটা স্থির নদীতে মাওলানা যে উত্তাল গর্জন তুলেছিলেন, তা আবারো স্থির হয়ে গেছে। সবাই কাজ নিয়ে নিদারুণ পেরেশান। দর্শনে আদৌ কোন কারেকশন প্রয়োজন কি না, তা ভাবারও যেন সময় নেই। কাজ আর কাজ। 'শুধু কাজ করে যাও; সফলতা আসবেই'- যেন এক অঘোম বার্তা। মাওলানা যে দর্শন দাঁড় করালেন, তার শানে নুযুল জানার আমাদের যেন কোনই ইচ্ছে নেই। একটি গাড়ি স্টার্ট দেয়ার সময়ে ড্রাইভার যা যা করেন, একটু পরে দ্রুত লক্ষ্যপানে পৌছতে আরেকটু কাজ করতে হয়। গিয়ার চেঞ্জ করতে হয়। ফাঁকা রাস্তায় চার নম্বর গিয়ারে ছোটা যায়। আবার সামনে কিছু এলে ব্রেকও করতে হয়। স্টার্টিং ড্রাইভার যা কিছু করেছে- তা ই স্বতঃসিদ্ধ কালোত্তীর্ণ হিসেব নয়।


মনে রাখা দরকার- কোন কর্মসূচী বাস্তবায়নের আগে তার পেছনের দর্শনটা ঠিকঠাক থাকা চাই। তাতে কর্মসূচী বাস্তবায়নকারী জনশক্তির মানসিক দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায়। 





Tuesday, November 22, 2016

জীবন থেকে দেখা বাংলাদেশী ব্র্যান্ড ডেমোক্রেসি (পর্বঃ ০২)

রাজনীতি নিয়ে কথা বলি, বলতে চাই। অধিকাংশ তরুণের "I hate Politics'' দর্শনের মাঝে কেন জানি আমিপলিটিক্সকেই খুব বেশী ভালবেসে ফেলেছি। রাজনীতি নিয়ে পড়তে, ভাবতে, জানতে ভাল লাগে। ইদানিংআমার একটা দারুণ রকমের সুবিধা হয়েছে। নিজের ছোট্ট জীবনে পাওয়া অভিজ্ঞতা থেকেই রাজনীতির চেহারাকে বেশ ভালভাবে দেখতে পারি।

বাংলাদেশের রাজনীতির ইন্টারফেস কি? চোখ বন্ধ করে একটু ভাবুন প্লিজ। রাজনীতি শব্দ উচ্চারনের বলতেই 'ভোট' আর 'ক্ষমতা'। 
তরুণ বয়সেই কিভাবে যেন 'ভোট' আর 'ক্ষমতার' সাথে মল্লযুদ্ধ করার সুযোগ হয়েছিল। সেখান থেকেই আমি বাংলাদেশী রাজনীতির একটা নতুন ব্র্যান্ডের সন্ধান পেয়েছি। নাম দিয়েছি-বাংলাদেশী ব্র্যান্ড 'ডেমোক্রেসি'। 
বিশ্বাস করুন- ভোটের রাজনীতিতে অংশ না নিলে আপনি কখনোই আমার এই নিউ ব্র্যান্ড ডেমোক্রেসির চেহারা দেখতে পাবেন না।

অনেকেই জানেন- বিগত ইউপি নির্বাচনে আমি বগুড়ার একটি ইউনিয়ন থেকে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছিলাম। আমার চেয়ে ৪০ বছরের সিনিয়র, আমার শিক্ষকের কাছে ১৬ ভোটে হেরে গিয়েছিলাম। এই ফলাফল নীরবে মেনে নেওয়া এবং নব-নির্বাচিত চেয়ারম্যান স্যারকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানোকে কেন্দ্র করে আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ভয়ংকর এক কালিমা লেপন করে দেয়া হয়েছে- ''তা হিলারী প্রেসিডেন্সি পরাজয় এবং একজন বাংলাদেশী তরুনের পরাজয়'' শিরোনামে স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেছিলাম। আজ ঠিক সে রকমই আরেকটু রাজনৈতিক জটিলতার উপাখ্যান তুলে ধরছি। আগেই বলে রাখি- আমি খুব দুর্বল ও ছোট মানুষ। নিজের ছোট্ট রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকেই রাজনীতি নিয়ে কথা বলছি। আমি জানি- কিছু ভাই- আমার এই আত্মকেন্দ্রীক বর্ণনায় উষ্মা প্রকাশ করবেন। আপনাদের বিরক্তির কারণ হওয়ায় ক্ষমা চেয়ে সচেতনভাবেই দায় নিচ্ছি। নিজের জীবন থেকে বলার সুবিধা হলো- কনফিডেন্সের সাথে একদিকে অবস্থান নেয়া যায়।

আমি যেমন নিউ ব্র্যান্ড ডেমোক্রেসিতে বড় সংকট হিসেবে দেখছি- সাধারন নাগরিক ও ভোটারদের চিন্তা ও আকাঙ্খার দৈণ্যতাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় সংকট। এই লিখার উপসংহারে লাইনটি এমন হতে পারে- "সূতরাং বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ব্যর্থতার বড় দায়টি নাগরিকদের কাঁধে।'' এই লাইনটি পড়ে আমাকে যারা ইতোমধ্যে বকাঝকা শুরু করেছেন, তাদের ধন্যবাদ এখন একবার জানিয়ে- এই লিখার শেষেও একবার ধন্যবাদ দিতে চাই। ততক্ষণ মনে মনে বকা দিয়ে লিখাটি পড়তে থাকুন প্লিজ।

উত্তরবঙ্গে শীত বেশ ভালভাবেই জেঁকে বসেছে। শীতের মৌসুম মানেই গ্রামে ওয়াজ মাহফিলের মৌসুম। অধুনা তার নাম হয়েছে তাফসীর মাহফিল। এসএসসি পর্যন্ত গ্রামে ছিলাম। দুর-দুরান্তে বাবা, চাচা এবং গ্রামের মুরুব্বীদের সাথে ওয়াজ শুনতে যেতাম। সত্যি বলতে কি- ওয়াজ মাহফিলে ওয়াজিনের ওয়াজ আমার মোটেই ভাল লাগতো না। আমি সেই ছোট্ট বয়সেই বুঝতাম- এই হুজুরেরা কোকিল কণ্ঠী, মিষ্টভাষী, আন্তর্জাতিক মুফাসসিরে কোরআন, ইসলামী বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হলেও বাস্তবে এরা টাকার চুক্তি করে ওয়াজ করতে এসেছেন। এই একটি কারনেই তাদের ওয়াজ আমার মোটেও সহ্য হতো না। আর ওয়াজে কিসের তাফসীর? সুরের নহর বইয়ে দিয়ে কেচ্ছা-কাহিনীতে ভরপুর কিছু জাহেলী কথাও বলতে শুনেছি। ইসলামের প্রানসত্বা নিয়ে মোটেও কোন কথা থাকতো না। ওয়াজ শেষে যে ভাষায় চাঁদা কালেকশন করতো, তাতে ১০/২০ টাকার বিনিময়ে জান্নাতে রাইয়ান পাওয়া যেতো। আর হাজার টাকা হলেও কনফার্ম জান্নাতের টিকেট। হুজুর বলছেন- 
যে দিবে টাকা দশ/
জান্নাতে যাবে ফসাফস/ (আঞ্চলিক ভাষায় ফসাফস মানে কোন বাঁধা ছাড়াই)
হুজুরদের ওয়াজ শোনার ন্যুনতম কোন ইচ্ছা না থাকা সত্বেও মাহফিলে যেতাম। মাহফিলে যেতাম- প্রধান অতিথী ও বিশেষ অতিথীর বক্তব্য শোনার জন্য। আপনাদের কাছে হাস্যকর হলেও এটাই আমার জীবনে সত্য। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম রাজনীতিবিদ হবো। তাই রাজনীতিবিদরা ওয়াজ মাহফিলে এসে কিভাবে নিজেদের এপ্রোচ করে, কথা বলে, পাবলিক রিলেশন করে- খুঁটেখুঁটে দেখতাম। নিজেকে অতিথীদের আসনে কল্পনা করে রিহার্সেলও করতাম। ভুলে যাবেন না- আমি তখন ক্লাস সেভেন/এইটের ছাত্র। নেতৃত্বের লোভ, ক্ষমতা ও রাজনীতির বেনিফিট সে অর্থে বুঝার বয়স তখনো হয় নি। স্রেফ রাজনীতি ভাল লাগতো- এই জায়গা থেকেই নিজেকে দেখতাম। বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের সামাজিক ইনফ্লুয়েন্স আমার কিশোর মনে ইনফ্লুয়েন্সিভ হওয়ার বীজ বুনেছিলা।

গত ১৫ দিনে আমার কাছে কমপক্ষে ১০ টি ফোন এসেছে। এলাকার বিভিন্ন গ্রামের তাফসীর মাহফিলে অতিথী হওয়ার দাওয়াতের ফোন। সেই কিশোর বয়সের হাস্যকর স্বপ্ন যুবক বয়সেই বাস্তবে সামনে চলে আসবে- ভেবে শুধু হাসছি আর আগের দিনের ছেলেমানুষির কথা চিন্তা করছি। আমি বিনয়ের সাথে সকল দাওয়াতকে গ্রহন করেছি। কিছুটা রোমাঞ্চ তো আছেই। নামিদামী মানুষের সাথে আমিও গনমানুষের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মঞ্চে বসবো- ব্যক্তিপূজার জায়গা থেকে অনেক আকর্ষনীয় ব্যাপার। দূর্বল মানুষ হিসেবে আমারও ভাল লাগার বিশাল একটা উপলক্ষ এখানে আছে। আমি অতিথি হিসেবে ৫/১০ মিনিট বক্তব্য দেয়ার একটা খসড়া নোটও তৈরি করে ফেলেছি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্র্যাকটিস করেছি কিনা- সেটি অনলাইনে না বলি; আয়না, আমি আর আমার বউ জেনে থাক। এভাবে ওয়াজ মাহফিলের প্রস্তুতির মাঝেই জীবনকে বেশ সরেস উপভোগ্য মনে হতে লাগলো। ঢাকা থেকে এখন আমি এলাকায় যাচ্ছি- দাওয়াতী মেহমান হিসেবে। এলাকায় মাইকিং হচ্ছে আমার নামে। আমার জায়গায় আপনাকে কল্পনা করুন- বেশ তৃপ্তি পাবেন ( যদি আমার মত দূর্বল ঈমানদার হোন, তাহলেই কেবলমাত্র)।

আমার পৃথিবী আরেকবার উল্টে গেল। বাংলাদেশী ব্র্যান্ড ডেমোক্রেসির আরেকটি পৃষ্ঠা পড়তে হলো। আমার রোমাঞ্চ নিমেষেই উবে গেল। আমি এক নিষ্ঠুর ও ভয়ংকর সামাজিক ব্যবস্থার মুখোমুখি হলাম। লড়াই বলবো না। কেন এই বিশ্রী লড়াইয়ে আমি জিততে চাওয়া তো দূরের কথা অংশগ্রহনই করতে চাই না।
এলাকায় মাইকিং হচ্ছে- উক্ত মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ............... বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি..................... বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো উপস্থিত থাকবেন থানা বিএনপির সভাপতি......... বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো উপস্থিত থাকবেন সাবেক ছাত্রনেতা নূর মোহাম্মাদ আবু তাহের। আরো উপস্থিত থাকবেন............

এবার পাবলিক রিএকশন দেখুন। আচ্ছা- আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যানের সাথে একই অনুষ্ঠানে নূর মোহাম্মাদ কেন? আওয়ামী লীগের থানা সভাপতির সাথে একই অনুষ্ঠানে নূর মোহাম্মাদ কেন? তবে কি আওয়ামী-জামায়াত আঁতাত? তবে কি নূর মোহাম্মাদ বিক্রি হয়ে গেল? তবে কি নূর মোহাম্মাদ আদর্শ্চ্যুত হয়ে গেল? তবে কি নূর মোহাম্মাদ ......... হ্যান-ত্যান।

নির্বাচনের কর্মীবৃন্দ ফোনের পর ফোন দিতে থাকলো। এভাবে মাহফিলে আসা যাবে না। এভাবে আওয়ামী লীগের সাথে একই মঞ্চে ওঠা যাবে না। এভাবে এটা করা যাবে না। এলাকায় লোকজন ভুল ভাবছে। ............

আমি তখন হাসছি আর হাসছি। বাংলাদেশের নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি দেখেই হাসছি। রাজনীতির পাঠ পেয়ে হাসছি। এক অসহিষ্ণু রাজনীতির দীক্ষা পাচ্ছি। আমাকে যারা ভালবাসেন তারাও প্রশ্ন তুলছেন। যারা ঘৃণা করেন তারাও প্রশ্ন তুলছেন। যারা বিরোধীতা করেন তারা তো মোক্ষম অস্ত্র পেয়ে গেছে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার-সাধারণ নাগরিকরা পর্যন্ত ভাবছেন, আমার কোনভাবেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যানের সাথে একই মঞ্চে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও বসা উচিৎ হবে না। আমরা অনেকেই বলি- জামায়াত গনমানুষের আকাঙ্খাকে ধারণ করতে পারে না, লালন করতে পারে না। আমার এলাকার গনমানুষের আকাঙ্খা হচ্ছে- বিপরীত আদর্শের রাজনীতিবিদদের সাথে কোন বন্ধুত্বপূর্ণ ও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক রাখা যাবে না। একই মঞ্চে ওঠা যাবে না। আর জামায়াত আমাকে বিপরীত আদর্শের মানুষদের সম্মান করতে শিখিয়েছে, ভিনমতের মানুষের কাছে যেতে বলেছে। ভিন্নমতের মানুষদের সাথে একই মঞ্চে বসলে আমাকে শোকজ করা হয় না। এখন আমি বুঝতে পারছি না- গনমানুষের আকাঙ্খাকে লালন করে ভিন্নমতের আদর্শের সকল মানুষদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবো, নাকি গনমানুষের বিপরীতে গিয়ে তাদের সাথে সম্পর্ক অব্যাহত রাখবো? আমি কি ভিন্নমতের মানুষদের সামাজিকভাবে বয়কট করবো, না কি তাদের কাছাকাছি যাব?

আমি এই স্ট্যাটাস পাবলিকলি দিচ্ছি। আমার এলাকার অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী এই স্ট্যাটাসে বর্ণিত সংকটের সত্যতা নিরুপণ করবেন। আমি সত্যিই এক মানসিক সংকটে ভুগছি। রাজনীতি করতে গিয়ে কখনো ভয় পাইনি। শ্বাপদ-সংকুল পথ পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জেল-জুলুম-নির্যাতন, গ্রেফতার- শাহাদাতকে কবুল করেই এ পথে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু বাস্তব ময়দানে গনমানুষের সাথে রাজনৈতিক ময়দানে গিয়ে আমি গনমানুষের আকাঙ্খার যে দিকটি দেখছি- তাতে সত্যিই ভীষন ভয় পেয়ে গেছি। ভড়কে গেছি। হয়তো এই আকাঙ্খার সাথে অভ্যস্থ নই। সাধারণ মানুষ যেটাকে অন্যায়, আপোষকামীতা, আঁতাত বিবেচনা করছেন, সেটিকে আমি 'আদর্শিক অবস্থান' বিবেচনা করছি। কমন পিপলের সাথে এই সাংঘর্ষিক অবস্থান নিয়ে কতটুকু পথ চলতে পারবো জানি না।

একটি বিষয় পরিস্কার- বাংলাদেশী ব্র্যান্ড ডেমোক্রেসিতে আপনি যতক্ষণ ভিন্ন আদর্শের সাথে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে লিপ্ত আছেন, মঞ্চে উঠে গালাগালি করতে পারবেন, পিষিয়ে মারতে চাইবেন, তাদের ধুইয়ে দিতে পারবেন, ততক্ষন আপনি স্ব-আদর্শের উপরে আছেন বলে বিবেচিত হবেন। আপনি আঁতাত করেন নি বলে বিবেচিত হবেন। কিন্তু যখনই আপনি উদার বুকে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিবেন, পরাজিত হয়ে বিজয়ী প্রার্থীকে সহযোগীতা করবেন, তার সাথে সামাজিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখবেন, একই মঞ্চে উঠবেন, শ্রদ্ধার চোখে দেখবেন- তখনই আপনি আদর্শ্চ্যুত, আঁতাতকারী, আমানতের খেয়ানতকারী বলে বিবেচিত হবেন।

ওয়াল্লাহি- বাংলাদেশে আওয়ামী রাজনীতির দর্শন ও আদর্শকে প্রচন্ড ঘৃণা করি। বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ইসলামী আন্দোলনকে ফেরাউনি স্টাইলে দমিয়ে দেওয়ার কারিগর আওয়ামী জাহেলী দলকে আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। যতদিন বাঁচবো, সেক্যুলার আওয়ামী রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করেই বাঁচবো ইনশাআল্লাহ। কিন্তু আমি দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলি- এলাকার আওয়ামী-বিএনপি সহ আমার বিপরীত আদর্শের প্রত্যেকের কাছে আমি গিয়েছি, যাই এবং ভবিষ্যতেও যাব। কিন্তু বাংলাদেশী ব্র্যান্ড ডেমোক্রেসিতে সাধারণ মানুষের যে চরিত্র ও আকাঙ্খা দেখেছি- সেখানে অনেক দূরের পথ পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়া উপায় নেই। দিল্লী দূর অস্ত।

আমি স্ট্যাটাসের মাঝে লিখেছিলাম ---এই লিখার উপসংহারে লাইনটি এমন হতে পারে- "সূতরাং বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ব্যর্থতার বড় দায়টি ভোটারদের কাঁধে।'' উপসংহারে সেটি না লিখে লিখছি- "সূতরাং বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ব্যর্থতার বড় দায়টি নাগরিকদের কাঁধ থেকে সরিয়ে নিতে আদর্শিক রাজনীতিবিদদের অনেক দূরের পথ পাড়ি দেয়ার হিম্মত থাকতে হবে"।

Thursday, November 10, 2016

হিলারীর প্রেসিডেন্সি পরাজয় এবং একজন বাংলাদেশী তরুণের পরাজয়



গনতন্ত্র, নির্বাচন, সহনশীলতা ও উদারতা, ফলাফল মেনে নেওয়া- কথাগুলো নির্বাচনকালীন সময়ে খুব বেশী উচ্চারিত হয়। গত পরশুর আমেরিকার নির্বাচন, ট্র্যাম্পের বিজয়- হিলারীর পরাজয় দেখছিলাম আর মনের কোনে কিছু ভাবনারা এসে উঁকি মারছিল। ফেসবুকে ও টুইটারে খুব খেয়াল করে আমেরিকার নির্বাচন ফলো করছিলাম। খুব ছোটবেলা থেকেই বাবাকে নির্বাচনের প্রক্রিয়াতে দেখেছি এবং মাত্র ২৮ বছর বয়সে নিজের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সৌভাগ্য হয়েছিল। উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার কাঠামোর একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে নির্বাচন করার ফলশ্রুতিতে কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে। আপনা্রা অনেকেই স্ব-স্ব জায়গাতে অনেক বড় মানুষ হলেও হয়তো বা নির্বাচনী মাঠে প্রার্থী হয়ে আমাদের সমাজব্যবস্থা, নির্বাচন কাঠামো, গনমানুষের দর্শন এবং বাংলাদেশী ব্র্যান্ডের ডেমোক্রেসীর চরিত্র দেখার সুযোগ হয়নি। আমার ব্যক্তিজীবন থেকে আমেরিকান ব্র্যান্ড ডেমোক্রেসি এবং বাংলাদেশী ব্র্যান্ড ডেমোক্রসির মাত্র একটি বেদনাদায়ক চরিত্র উল্লেখ করছি।

এক, 

আমেরিকার নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী হিলারী ক্লিনটনের পরাজয়ের পরের ভাষনের শুরুর কয়েকটি লাইনে চোখ বুলিয়ে নিন।
"Thank you, my friends. Thank you. Thank you. Thank you so very much for being here. I love you all. Last night I congratulated Donald Trump and offered to work with him on behalf of our country. I hope that he will be a successful president for all Americans. This is not the outcome we wanted or we worked so hard for, and I'm sorry we did not win this election for the values we share and the vision we hold for our country."

দুই,
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের চরম জুলুম-নির্যাতন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও প্রতিপক্ষ দমনের উৎসবের মাঝেও যৌবনের সেরা সময়ে ছাত্রসংগঠনে দায়িত্বপালনরত অবস্থায় প্রার্থী হয়ে ঝুঁকি নিয়েছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে- যেদিন ঢাকা ছেড়ে এলাকায় ক্যাম্পেইন করতে বাসে উঠেছিলাম, তখন ঢাকা শহরকে দেখছিলাম আর অশ্রুনয়নে ভাবছিলাম- আর বুঝি কখনো এই চেনা শহরে ফেরা হবে না। ধরে নিয়েছিলাম- নির্বাচনকালীন সময়েই হয়তো কারাগারের ভেতর খন্ডকালীন বসতি অথবা ক্রসফায়ারের নাটকে কবরে স্থায়ী বসতি হতে পারে। আল্লাহ্‌ যতটুকু বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা দিয়েছেন, তা ব্যবহার করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছি, ক্যাম্পেইন করেছি। আমি যখন ক্যাম্পেইন শুরু করি- প্রতিদ্বন্দ্বী সকল প্রার্থী-সমর্থকরা শ্লেষের হাসি হাসতো, 'পিচ্চি চেয়ারম্যান' বলে টিপ্পনী কাটতো, রাঘব-বোয়ালদের তুলনায় আমাকে 'ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা' বলতো। হজম করেছি। নীরবে আমি আমার লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে আমাদের স্বপ্ন, পরিকল্পনা ও এজেন্ডার কথা ঘরে-ঘরে, অলিতে-গলিতে, হাটে-বাজারে, প্রতিটি জনপদে বলার চেষ্টা করেছি। প্রতিপক্ষের ছিল অর্থ, প্রভাব, ক্ষমতা। আমাদের ছিল বিশ্বাস, পরিশ্রম আর নির্লোভ কর্মীবাহিনী। আল্লাহ্‌ তায়ালার অপার রহমতে ইউনিয়নের জনগণ আমাদের ভোট দিয়েছিল। মাত্র ১৬ ভোটে পরাজিত হয়ে দ্বিতীয় হয়েছি। যিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক দু'বারের চেয়ারম্যান। যিনি তৃতীয় হয়েছেন, তিনি সাবেক দু'বারের চেয়ারম্যান। যিনি চতুর্থ হয়েছেন তিনি সাবেক একবারের চেয়ারম্যান। যিনি পঞ্চম হয়েছেন তিনি এলাকার শিল্পপতি। আল্লাহ্‌ আমার মত নস্যি একটা তরুণকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছেন। রাঘব-বোয়ালদের মোকাবেলায় ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা হয়ে ওনাদের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিলাম।

তিন,
এতক্ষনে নিশ্চয় ভাবছেন- আমেরিকার প্রেসিডেন্সি নির্বাচনে হিলারীর পরাজয়ের সাথে আমার মত ছোট মানুষের ইউপি নির্বাচনের পরাজয়ের আলোচনার হেতু কি? 
হ্যাঁ, হেতু আছে। গত মে মাস থেকে বুকে বিশাল কষ্টের পাহাড় চেপে নিয়ে পথ চলছি। ডেমোক্রেসি ও ইলেকশন প্রসেস নিয়ে যারা অবিরত কথা বলছেন, তাদের সর্বপ্রথম বাংলাদেশী সমাজব্যবস্থার চিরায়ত দর্শন এবং গনমানুষের চিন্তা-ভাবনার ব্যাপারে অধ্যয়ন করা দরকার।

ট্র্যাম্প তার ক্যাম্পেইনে কি জঘন্য ভাষায়ই না হিলারীকে আক্রমন করলো। হিলারী অযোগ্য, টেরোরিজমের গডমাদার, শারীরিকভাবে আনফিট, যুদ্ধবাজ, মহিলা প্রার্থী বলা সহ অপমানজনক অনেক কথা বললো। এমনকি পরাজিত হলে ফলাফল মানবেন না বলে ট্র্যাম্প সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন। আমেরিকার সকল মিডিয়া হিলারী পক্ষে ভূমিকা রাখলো। বিশ্বের প্রায় সকল মানুষ (রাশিয়া ছাড়া) বাস্তবিক কারনেই হিলারীর শিবিরে অবস্থান নিল। নির্বাচন হলো। ফলাফল হলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে হিলারী হেরে গেলেন। জিতলেন এক উন্মাদ মানুষ। এখন এই ভদ্র মহিলার মানসিক অবস্থার কথা একবার চিন্তা করুন তো? কেমন হওয়া উচিৎ রিএকশ্যন? শুনুন হিলারীর মুখেই- 
Last night I congratulated Donald Trump and offered to work with him on behalf of our country. I hope that he will be a successful president for all Americans.

এটিই ডেমোক্রেসির essence of Beauty. এটি গনতন্ত্র। এটিই নির্বাচন। সহনশীলতা ও উদারতা একেই বলে। এটিই আমেরিকান ব্র্যান্ড ডেমোক্রেসি। আপনাদের অনেকের মনে আছে ব্যারাক ওবামার কাছে পরাজিত হয়ে সিনেটর জন ম্যাককেইন বলেছিল- From today, Obama is my president.

চার, 
২৮ শে মে, ২০১৬। সন্ধ্যাবেলা। আমার ইউনিয়নের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষনা হলো। আমি কৌশলে প্রত্যেক কেন্দ্রের এজেন্টের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষনা করার আগেই ফলাফল জেনে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। ৪.০০ টার সময় ভোট গ্রহণ বন্ধ হয়েছিল। সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই আমি সোর্স থেকে ফলাফল পেয়ে বুঝে গেলাম ১৭ ভোট শর্ট (পরে অবশ্য ১৬ ভোট গ্যাপ হয়েছিল)। আমি আমার নির্বাচনী মূল অফিস থেকে উঠে গিয়ে বাজারের মসজিদে গেলাম। সেজাদায় পড়ে আল্লাহ্‌র কাছে জানতে চাইলাম- এখন আমার কি করা উচিৎ? তিনটি কাজ করতে পারতাম- বিনাবাক্যে ফলাফল মেনে নেওয়া, ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে মামলা করে পুনরায় ভোট গণনা্র ব্যবস্থা করা, কেন্দ্রে দাঙ্গা-হাঙ্গামা লাগিয়ে ভোটের ফলাফল স্থগিত করা। সিজদা থেকে উঠে বিনাবাক্যে ফলাফল মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়ি, আদালতের স্বেচ্ছাচারিতা সহ সার্বিক দিক বিবেচনা করে হঠকারিতার দিকে যাওয়াকে ভাল মনে করিনি। বিশেষ করে আমার রাজনৈতিক দল আমাকে বরাবরই সহনশীল ও উদার রাজনীতির শিক্ষা দিয়েছে।

একটু পরেই আনুষ্ঠানিক ফলাফল হলো। যথারীতি ১৬ ভোট শর্ট। কর্মী-সমর্থকরা ইমোশোনাল হয়ে যাচ্ছিল। কে যেন কানের কাছে এসে বললো- ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে উপজেলা নির্বাচন অফিস ঘেরাও কর্মসূচী ঘোষনা করে দাও। আমি একটা উঁচু চেয়ারের উপর উঠে ঠান্ডা মাথায় বক্তব্য দিলাম। ফলাফল মেনে নিলাম। কর্মীদের আবেগতাড়িত না হয়ে ফলাফল মেনে নেওয়ার অনুরোধ করলাম। নব-নির্বাচিত চেয়ারম্যান সাহেবকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সালাম পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলাম। কর্মীরা মনঃক্ষুণ্ণ হলেও মেনে নিল। সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম।

রাত ১২.০০ টার দিকে নতুন চেয়ারম্যান আমাকে ফোন দিলেন। আমি শুভেচ্ছা জানালাম আর ওনি আমাকে শান্তনা দিলেন। পরের দিন আমার বাসায় আসার অনুমতি চাইছিলেন। ওনার সাথে আমার বয়সের ব্যবধান কমপক্ষে ৫০ বছর। আমার বাবার সরাসরি শিক্ষক। বিনয়ের সাথে ওনাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম- 'বাসায় স্বাগতম স্যার। তবে আমিই আপনাকে সকালে শুভেচ্ছা জানাতে আসবো ইনশাআল্লাহ্‌।' পরের দিন ২৯ শে মে সকালে ওনার নির্বাচনী অফিসে গিয়ে শুভেচ্ছা জানালাম। ওনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, কপালে চুমো দিলেন, দোয়া করে দিলেন। ওনার গলার মালা খুলে আমাকে পড়িয়ে দিলেন। উপস্থিত সকলের উদ্দ্যেশ্যে আমাকে কথা বলার সুযোগ দিলেন। আমি সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে পরাজয় স্বীকার করে নব নির্বাচিত চেয়ারম্যানকে বরণ করে নিয়েছিলাম। দ্যাটস অল।

পাঁচ,
এরপর আমি এক নিষ্ঠুর পৃথিবীর মুখোমুখি হলাম। এ এক অন্য রকমের পৃথিবী। আমাকে পছন্দ করতো না এমন লোক তো অবশ্যই ছিল। নির্বাচনের মাঠে তারা নাস্তানাবুদ হয়ে গিয়েছিল। বাঘা-বাঘা তিন চেয়ারম্যানকে টপকিয়ে আমি আশাতীত ফলাফল করেছিলাম। যারা আমাকে ভোট দেয়নি, তারাও ১৬ ভোটের পরাজয় দেখে ব্যথিত হয়েছিল। অনেকে আগামী নির্বাচনে আমাকে বিপুল ভোটে জয়লাভের স্বপ্ন দেখিয়ে শান্তনা দিচ্ছিলেন। এলাকাজুড়ে আমাকে নিয়ে এক তুমুল আলোচনা শুরু হয়ে গেল। ঠিক এমন সময়েই শত্রুরা আগামীদিনের রাজনীতিতে আমাকে বিব্রত করার রসদ তৈরী করে নিল। আঁধারের খেলোয়ারড়া সক্রিয় হয়ে উঠলো। এলাকাজুড়ে প্রশ্ন তুললো-

  •  মাত্র ১৬ ভোটে পরাজিত হয়ে কেন ফলাফলে মেনে নিলাম? 
  •  কেন ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে মামলা করলাম না?
  •  কেন নব-নির্বাচিত চেয়ারম্যানের অফিসে শুভেচ্ছা জানাতে গেলাম? 
  •  কেন নতুন চেয়ারম্যান আমাকে ফুল দিয়ে বরণ করলেন এবং আমি ওনাকে কেন বরণ করে নিলাম। তাহলে কি  আগে থেকেই গোপন সমঝোতা ছিল? 
  •  নতুন চেয়ারম্যান কেন আমার প্রশংসা করলো? 
  •  রাজনৈতিক ও আদর্শিক শত্রু প্রতিপক্ষ চেয়ারম্যান প্রার্থীর সাথে সাক্ষাৎ করলাম কেন? 
..............................................................................
..............................................................................
কেন? কেন? কেন? কেন? প্রশ্নের যেন শেষ নেই আর !

এক কান, দু'কান করে পুরো ইউনিয়নব্যাপী আমার বিরুদ্ধে এক ভয়ংকর অপপ্রচার শুরু হয়ে গেল। সাধারন মানুষদেরকে পর্যন্ত ওরা কনভিন্স করলো- 'নূর মোহাম্মাদ চেয়ারম্যান পদে জিতে গিয়ে চেয়ার ছেড়ে দিয়েছে।' আমার পৃথিবীটা ছোট হতে লাগলো। ফেসবুকে অনেক শিক্ষিত লোকজনও আমাকে নিয়ে ইনবক্সে উষ্মা প্রকাশ করলো। পরিবারের লোকজনও বকাঝকা শুরু করলো। সাংগঠনিক ভাইদেরও উত্তর দিয়ে খুশী করতে পারছিলাম না। এলাকার অনেক নাগরিক ভোটারবৃন্দ আমার এই 'মারাত্মক অপরাধে' কষ্ট অনুভব করলো। কিছু মানুষ তো বিশ্বাস করে বসলো- আমার বাক্সে ভোট পড়লেও আমি আসলে সেসব ভোট অন্য প্রার্থীকে দিয়ে দিয়েছি। নির্বাচনে পরাজয়ে কি আমি শ্বান্তনা পাবো, উল্টো আমাকে বিভিন্ন এলাকা সফর করে শুভেচ্ছা জানানোর ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছিল। মাত্র ২৮ বছর বয়সে ১৬ ভোটের পরাজয় আমাকে যতটা কষ্ট দেয় নি, ভোটের পরের ফলাফল মেনে নেয়া এবং শুভেচ্ছা বিনিময়ের এই ঘটনা আমার বুকে বিশাল এক কষ্টের পাথর চাপিয়ে দিল। আমি রাতে একাকী গুমড়ে কাঁদতাম। জীবনের শুরুতেই এতবড় একটা পরাজয় উদার বুকে মেনে নিয়েছিলাম, বিজয়ী চেয়ারম্যানকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম- সবাই এটাকে স্যালুট করবে। আমার ভদ্রতা ও সৌজন্যতাকে সম্মান করবে। নাহ- আমি নিষ্ঠুর প্রত্যাঘাত পেলাম। আমি বাংলাদেশী সমাজব্যবস্থা ও রাজনীতির পাঠ তখনো ভালভাবে শিখতে পারি নি।

ছয়ঃ
এই ঘটনা আমার চিন্তার জগতে আমুল পরিবর্তন এনে দিল। ভবিষ্যতে আর কখনো ভোটের রাজনীতিতে অংশগ্রহন করবো কি না জানি না। গতকালের সিএনএন এ হিলারীর ভাষন শুনছিলাম আর আমার জীবনের সাথে কথাগুলো মিলিয়ে নিচ্ছিলাম। আপনারা হিলারী ভাষনকে কিভাবে নিয়েছেন জানি না। তবে আমি ভাষন শুনে আমেরিকান ডেমোক্রেসি এবং বাংলাদেশী ডেমোক্রেসির একটা ক্ষুদ্র পার্থক্যকে জীবন থেকে দেখছি। ডেমোক্রেসির বিউটি দেখার আগে আমাদের সমাজের নাগরিক এবং রাজনৈতিক কর্মীদের চিন্তার রাজ্যকে আগে পরিমার্জিত করতে হবে। বিদ্যমান রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতিই আমাদের পুড়িয়ে মারছে। হিলারী আজ প্রতিপক্ষ ট্র্যাম্পকে অভিনন্দন জানিয়ে নিশ্চয় প্রশংসিত হচ্ছেন। আর আমি ছোট একটা ইউনিয়নে স্রেফ একই কারণে অনেকের কাছে নিগৃহীত হয়েছি।

মুখে ডেমোক্রেসি ডেমোক্রেসি বলে যতই ফেনা তুলি না কেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে যতই দোষারোপ করি না কেন- নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের দায় এড়াতে পারি না। 

Saturday, November 5, 2016

বিএনপির উচ্চমার্গের পররাষ্ট্রনীতি

পিএইচডি করার ইচ্ছে ছিল না। ইদানিং হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মী বলেই কিনা ! টপিকও ঠিক করে ফেলেছি। এখন আপনারা সায় দিলেই একশ্যান শুরু করবো। আপনাদের 'সায়' নেয়ার প্রাসঙ্গিকতা আছে। কারণ- পিএইচডি কালীন সময়ে আপনাদের সাহায্য ব্যতিত আমি কোনভাবেই সফল হতে পারবো না। ওকে, ভূমিকা বাদ। আগে বলে নিই- আমার পিএইচডি গবেষনার টপিক কি?

''বিএনপির রাজনৈতিক কূটনীতি ও দুর্বোধ্য পররাষ্ট্রনীতি''। ইতোমধ্যে যারা পিএইচডি করেছেন অথবা করছেন- তারা এই টাইটেল দেখে নাখোশ হলেও আমার কিচ্ছু করার নাই। আমি এইটা নিয়েই কাজ করবো। একাডেমিক সংজ্ঞায় এটি কতটা জ্ঞাণগর্ভ রিসার্চ হবে জানি না। কিন্তু বর্তমানের বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে এ ধরনের একটি রিসার্চের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি, বেশ কিছুদিন ধরে। কেউ এগিয়ে আসছে না, বিধায় কি আর করার?

থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দেয়ার হুমকী শুনি প্রায়শই। বাস্তবেও তা ঘটে। এই যেমন শরীয়তপুরে ছাত্রলীগ নেতার থাপ্পড়ে থানার এসআই এর দাঁত পড়ে গেল। তাই বলে থাপ্পড় মারলে যে পররাষ্ট্রনীতিও চীন থেকে ঘুরে দাদার দেশে চলে আসে ভাবতে পারি না। বগুড়ায় জন্মেছি, বড় হয়েছি। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে বিএনপির রাজনীতি ও নীতি -আদর্শ নিয়ে বয়ান শুনে শুনে অভ্যস্ত। সারাজীবন শুনলাম- চীন হচ্ছে বিএনপির পেয়ারে দোস্ত। আপনারা জানেন- বগুড়া বিএনপির ঘাঁটি ছিল (সচেতনভাবেই ছিল বলছি-কারন এখন আর সেই ঘাঁটি নেই)। সবাই জানে মেজর জিয়ার জন্মস্থান বলেই বগুড়া বিএনপির ঘাঁটি হয়েছে। কথা সত্য। কিন্তু এতটুকু বললেই বগুড়ার রাজনীতির দর্শন ও গনমানুষের চরিত্র সম্পর্কে ধারনা পরিস্কার হবে না। বাস্তবে বগুড়ার মানুষ প্রচন্ড ভারত বিরোধী। ছোটবেলায় মুরুব্বীদের মুখে গল্প শুনেছিলাম- একদিন বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে সেনা কর্মকর্তাদের দুইজন 'র' এর এজেন্ট হিসেবে ধরা পড়েছিল। সম্ভবত ৮০ সালের দিকের ঘটনা। ঐ দুই বিশ্বাসঘাতককে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের উপর গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। টানা তিনদিন রাস্তায় লাশ ঝুলিয়ে বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। মূলতঃ এই ছোট্ট ঘটনাকে আপনারা বগুড়াবাসীর ভারত ঘৃণার ট্রেইলার ভাবতে পারেন। মেজর জিয়া ও বিএনপির ভারতবিরোধী নীতিই বগুড়া এবং সমগ্র উত্তরবঙ্গে তাদের এত জনপ্রিয় করে তুলেছিল। এখন এতটা জনপ্রিয় আর নেই। কেন নেই- আশা করি তার ব্যাখ্যা আর দিতে হবে না। এখন আপনারা যারা গ্লোবাল পৃথিবীর এত্ত বড় বুকওয়ালা নাগরিক, তারা বগুড়া বাসীর এই ভারতবিরোধীতার সংকীর্ণ জাতীয়তাবোধ নিয়ে আমাকে খোঁচা মারতেই পারেন। তবে জেনে রাখুন- বগুড়াসহ সমগ্র উত্তরবঙ্গের মানুষ বিশ্বাস করে- ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ যদি কোন নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের ঝুঁকিতে থাকে, তবে সেই ঝুঁকি একমাত্র ও কেবলমাত্র ভারতের দিক থেকেই আসবে।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে বাকশালী আওয়ামী সরকার আর তাদের প্রভু রাষ্ট্রের যৌথ প্রযোজনায় বিএনপিকে চুবানীর পর চুবানী দেয়া হলো। ঢাকা সেনানীবাস থেকে এক কাপড়ে বাড়ি ছাড়া করলো। বালুর ট্রাক দিয়ে গুলশানে আটকিয়ে রাখলো। ৫ ই জানুয়ারীর অবৈধ নির্বাচনে কাপড় খুলে ভারত বাকশালীদের গা ধুয়ে দিল। তখন বিএনপি ভাবলো- দাদাদের সাথে পীড়িত না করলে ক্ষমতায় আসা যাবে না। পররাষ্ট্রনীতিকে ১৮০ ডিগ্রী উল্টিয়ে ভারতের দিকে তাক করলো। 'আমরা ভারতের শত্রু নই' বলে মুখে খই ফুটিয়ে প্রমাণ করতে চাইলো বিএনপি ভারতের বন্ধু। কেউ কেউ ভাবলো- মোদি ক্ষমতায় আসলে দুনিয়া উল্টে দিবে। হুম---- মোদি জ্বী আসলো। এক হালি ঘোড়ার আন্ডা প্রসব করলো। ওরে খালা, ভারতের সাথে একদলের যেখানে লিভ টুগেদার চলছে, সেখানে পরকীয়া করে অধিকার আদায়ের চেষ্টা কেমন ছেলেখেলা হয়ে যায়, বুঝতে পারো না। ভারত কোন দুঃখে আওয়ামী সঙ্গী ফেলে বিএনপিকে বুকে টেনে নিবে? কিসের ঠেকা ওদের?

ছাগলামী করতে করতে চীনের ঘরটাও বিএনপি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিলো। চীন দেখছে- আমার বন্ধু আস্থাহীনতায় ভোগে, আমার শত্রুর (ইন্ডিয়ার) কাছে যাওয়ার ব্যাকুলতা দেখায়, তখন আমারও তো কিছু করার আছে। এই নে- আওয়ামী বাকশালীরাও আমার বন্ধু। তাতে ইন্ডিয়ার গালে একটা থাপ্পড় হলো, আর রামছাগল বিএনপিকেও মূলা খাওয়ানো হলো। বাকশালীরা চীনাদের বুঝালো- আমরা বাংলাদেশে চাইনিজ ব্রান্ড ডেমোক্রেসি চালু করছি। মানে সরকাররে গৃহপালিত বিরোধী দল। চীনে যেমন ক্ষমতাসীন চাইনীজ কমিউনিষ্ট পার্টি আর তার সাথে গৃহপালিত বিরোধী দল, বাংলাদেশেও তেমন বাকশালী আওয়ামী পার্টি ও তার সাথে হুমু এরশাদ- রওশন ম্যাডামের মজার দল। খাপে খাপ। চীন দেখলো- আওয়ামী লীগ তো আমার খালাতো ভাই। ধর, বুকে টেনে ধর।

বুকে হাত রেখে বিএনপি বলতে পারবে না- তাদের পররাষ্ট্রনীতি আসলে এখন কোথায় আছে? পৃথিবীর ইনফ্লুয়েন্সিভ রাষ্ট্রগুলোও বিএনপির দুর্বোধ্য পররাষ্ট্রনীতি স্টাডি করতে পারে না। কোন দেশ, কিসের ভিত্তিতে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনবে ভাই? আপনি নির্যাতিত, বাড়ি ছাড়া, সন্তানহারা, নির্বাসিত, মজলুম- ঠিক এই কারনেই আপনাকে ক্ষমতায় আনতে হবে? এই সংজ্ঞায় বর্তমান শাসকগোষ্ঠিও বাবা হারা, গ্রেনেড খাওয়া, জেলে যাওয়া, ত্যাগ স্বীকার করা দল। আসলে আন্তর্জাতিক ইনিশিয়েটরদের কাছে বিএনপির মেসেজ কি? একদিকে বাকশালী শাসকরা তাদের চিরন্তন বন্ধুদের সাথে নিয়ে প্রতিপক্ষের বিএনপির দীর্ঘদিনের বন্ধু চীনকেও প্রেমের ভাগ দিতে চাইছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে খামোশ বলে, তখন আপনি যতই অবাক হোন না কেন- পেছনে রাশিয়ার বড় হাতের ছায়াটাও দেখতে হবে।

ধুর, এৎ কথা বলে কি লাভ?
কে শুনবে, আমার প্রলাপ?

এসএসসিতে উচ্চতর গনিত পড়েছিলাম। ভাবতাম এসব গনিতের জটিল সমীকরণ বাস্তব জীবনে কি কাজে লাগবে? গনিতে ভালই ছিলাম। বরাবর জটিল সবকিছু নিমিষেই সমাধান করতাম। কিন্তু মাগার, বিএনপির উচ্চতর পররাষ্ট্রনীতি ! এই জটিল সমীকরণ সমাধানের ক্ষমতা আমার মত সাধারন নাগরিকের নেই। আর বিএনপির সাধারণ মানুষের দরকারও নেই। উচ্চমাঙ্গের এলিট কোটেড-বুটেড লোকের পার্টি হলেই চলবে। গুলশানে কি আর সবার জায়গা হয় রে ভাই?

আচ্ছা- আমার পিএইচডি'র এই টপিক আপনাদের পছন্দ হয়েছে তো ?

Wednesday, November 2, 2016

আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট

"আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট"। এই কথামালা আমরা প্রায়শই বলে থাকি। কখনো কি এর মুখোমুখি হয়েছি?

হ্যাঁ, জীবনের এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি হয়েছি। বাংলাদেশী গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার 'আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে' বৃত্তবন্দী হয়ে পড়েছে আমার আজীবনের স্বপ্নেরা।

অর্থ ও সামাজিকতা- এই দুই সোশ্যাল ফোবিয়ার নির্মম আঘাত থেকে আর দশজনের মত আমিও নিজেকে হেফাজত করার অবিরত সংগ্রামে আছি। জানি না সামনে বিজয় না কি পরাজয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে যৌবনের সেরা সময়ে গনমানুষের পাশে দাঁড়ানোর বজ্রশপথে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হেঁটেছিলাম। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সাথে লড়াই করার অনেক উপাদান ছিল সত্য, ঘাটতি ছিল টাকায়। টাকার চোট থাকলে ১৬ ভোটের গ্যাপ হয়তো থাকতো না! মানবিক দুর্বলতায় প্রায়শই ভাবি- আমার মত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য রাজনীতির মাঠে বক্তৃতা করা সাজে, টাকাওয়ালাদের বিজয় মিছিলের মাঝে শ্লোগান দেয়া যেতে পারে; কিন্তু ভোটের মাঠে আমরা বড্ড অনুপোযুক্ত!

নির্বাচনের পর বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন কাছে আসে। তাদের চোখের ভাষা বুঝতে পারি বেশ! বুঝতে পারি তাদের আকাঙ্ক্ষা, অব্যক্ত কথামালা! কিন্তু!!!!!!! তখন আনমনে চুপসে যাই। মুখে কৃত্রিম হাসির টোল ফেলে ভেতরের দীর্ঘশ্বাসকে লুকিয়ে রাখি।

আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা যখন বলেন, গ্রামে ভাল একটা বাড়ি তৈরি করুন, এই বাজাজ মোটরসাইকেল দিয়ে আর হবে না- ভাল গাড়ি কিনুন, তখন মুখাবয়বে অটোমেটিক এক হাসির আবেশ চলে আসে। হেসেই বুঝিয়ে দিই- হুম, সহসাই আপনাদের দাবী পূরুন হবে।

আমি মানুষটা বন্ধুপ্রিয়। বন্ধুদের সাথে চলতে ভালবাসি। এলাকায় আসলেই স্কুল ফিল্ডের শেডে বসি। বন্ধুরা হরেক রকমের আলোচনা করে। মাস্টার্স পাশ করা বন্ধুরা স্বভাবতই চাকুরীর ইস্যু নিয়ে কথা বলে। তুমুল আলোচনা। কে কোথায় চাকুরী করছে, কার চাকরীর কি সমস্যা, কি সম্ভবনা - তা নিয়ে বেশ সরগরম আড্ডা। যে কোন আলোচনায় সবাই আমার মতামত জানতে চায়; কিন্তু চাকুরীর বিষয়টা এলেই সবাই আমাকে এড়িয়ে যায়। পলিটিশিয়ান ব্যক্তি চাকরীর কি বুঝবে? ওরা ধরেই নিয়েছে, আমাকে দিয়ে চাকরী হবে না। অথচ ওরাও জানে- ওদের ক্লাসে কখনো সেকেন্ড হইনি। একাডেমিক জীবনও বেশ ভাল করেই সমাপ্ত করেছি। কিন্তু জীবনের দর্শনের ভিন্নতায় ওরা আমাকে ব্যর্থদের কাতারেই ফেলে দিয়েছে। আমার চাকুরী নেই। ভাল একটা চাকুরী নেই। ওরাও জানে- আমি জব প্রিপারেশন মাস কয়েক নিলেই, রুটি রোজিগারে ঠেকবো না ইনশাআল্লাহ।

প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে সফরে বেড়িয়েছি। পথে স্ত্রীর সম্পর্কিত আংকেলের সাথে দেখা। ও যখন উচ্ছ্বাসের সাথে আমাকে ইন্ট্রোডিউস করে দিচ্ছিল, তখন আংকেলের প্রথম প্রশ্ন জামাই ঢাকাতে কি চাকুরী করে? আমি দেখলাম- ওর বিব্রত মুখে একটু আগের উচ্ছ্বাস আর নেই। থাকার কথাও নয়। শ্বাশুড়ী যখন তার আত্মীয়দের সামনে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন, তখন একটা সংকটের তৈরি হয়। জামাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, তো চাকুরী কি? যখন শোনে বিবিএ, এমবিএ করেছি- তখন ডাইরেক্ট প্রশ্ন কোন ব্যাংকে ঢুকেছি?

আমার মা সমাজে মাথা উঁচু করে বলতে পারেনা - জানো আপা, আমার ছেলে এবার ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে প্রমোশন পেয়েছে। আন্টিরা যখন মাকে তার মেধাবী বড় সন্তানের জব আইডেন্টিটির প্রশ্ন ছোড়েন, তখন ওনি উদাস মনে বলেন - কি বলবো আপা, পলিটিক্সের ঘোড়ারোগ ধরেছে।

ছোটবেলা বাবাকে দেখে স্বপ্ন গেঁথেছি- রাজনীতিবিদ হবো। আর কিছু করবোনা। গনমানুষের পাশে দাঁড়াবো। সেই স্বপ্নকে আজতক টেনে লম্বা করেছি। সম্ভবত আমি ইলাস্টিক টেনেছি। টানতে টানতে এখন ছিঁড়ে যাবার উপক্রম।

'আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট' এর যাঁতাকলে পড়ে পিষে যাচ্ছি। এই সমাজ আমাকে ভেঙচি কেটে বলছে- ভাত নেই পেটে, রসগোল্লা খাওয়ার বায়না ধরেছে। এখানে টাকা চাই, প্রচুর টাকা। সার্টিফিকেট আর মেধায় সম্মান খুঁজলে পণ্ডশ্রম হবে; সন্মান আর টাকা খালাতো ভাই-ভাই।

এই সমাজ একটা আইডেন্টিটি কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়ার প্রণোদনা দিচ্ছে অবিরত। জব আইডেন্টিটি। জব, চাকুরী, অফিসার। কে কত বেশী সফল- তার মানদণ্ড কে কত ভাল জব করে।

আমার মত যারা স্রোতের বিপরীতে চলার ইরাদা করেছেন - তারা এই আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার আক্রমণ থেকে মুক্তির উপায় সহসাই খুঁজে বের করুন। নইলে আপনার বিপরীত স্রোত প্রবাহমান স্রোতের টানে নিমিষেই দিক বদলে ফেলতে বাধ্য হবে।

মুসলিম মানসে ‘ইনশাআল্লাহ্‌’


আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলস বিমানবন্দর। ২৬ বছরের খায়রুদ্দিন মাখজুমি। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী। ৯ ই এপ্রিল লস অ্যাঞ্জেলস থেকে সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের বিমানে অকল্যান্ড যাচ্ছিলেন।


পরদিনই তার জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের আমেরিকার একাডেমিক ব্রিলিয়ান্টদের সম্মানে আয়োজিত ডিনারে অংশ নেয়ার কথা ছিল। এটা নিয়ে মাখজুমি দারুণ উত্তেজিত ছিলেন। তিনি বিমানে উঠার পর তার চাচাকে ফোন করেন। ওকল্যান্ডে পৌঁছানোর পর চাচা তাকে ফোন দেওয়ার কথা বলেন।


জবাবে তিনি বলেন- ইনশাআল্লাহ। মাখজুমির মুখে এ কথা শোনার পর পাশে সিটে বসা নারী যাত্রী দৌড়ে ক্রুদের কাছে ছুটে যান। মাখজুমি ভেবেছিলেন উচ্চঃস্বরে কথা বলার ব্যাপারে তিনি আপত্তি জানাতে গেছেন। কিন্তু দুই মিনিট পরই পুলিশ নিয়ে আসেন বিমানের এক কর্মকর্তা।


তাদের সঙ্গে থাকা গোয়েন্দা কুকুর তার ব্যাগ শুঁকতে থাকে। তার মানিব্যাগ কেড়ে নেয় এবং ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা জানতে চায়। এরপরই তাকে জোর করে বিমান থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ মাখজুমির ফোন রেকর্ড চেক করে এবং ইনশাআল্লাহ্‌র ব্যাখ্যা পেয়ে আট ঘন্টা পরে অকল্যান্ড যেতে দিয়েছিল। এই আলোচিত ‘ইনশাআল্লাহ’ তখন বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনামে পরিণত হয়েছিল। নিউইয়র্ক টাইমস শিরোনাম লিখেছিলঃ Inshallah Is Good for Everyone। 
আরবি ইনশাআল্লাহ শব্দের অর্থ- আল্লাহ চাহেন তো বা আল্লাহর ইচ্ছায় ('god-willing' or 'if god is willing')। শব্দটি মুসলমানরা হর-হামেশাই বলে থাকেন। এটা মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিশেষত্ব। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের ভাষার ভিন্নতা থাকলেও ভবিষ্যতের কোন কাজ সম্পাদনের সম্মতি ও প্রতিশ্রুতি বুঝাতে সকলেই আরবী ‘ইনশাআল্লাহ’ শব্দ ব্যবহার করে। মূলতঃ ইনশাআল্লাহ বলার মাধ্যমে ভবিষ্যতে সম্মাদিতব্য কোন কাজ, আনুগত্য, প্রতিশ্রুতি পালনের ক্ষেত্রে মুসলমানেরা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র সাহায্য কামনা করে এবং এর মাধ্যমে বিশ্বাস স্থাপন করা হয় যে- আল্লাহ তায়ালার কোন না কোনভাবে সহযোগীতা ব্যতিত ব্যক্তির পক্ষে তা সম্পাদন করা সম্ভব নয়। এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে- দুটি পক্ষের প্রতিশ্রুতির কেন্দ্রবিন্দু আল্লাহ তায়ালা; মানে ‘আল্লাহ চাহে তো আমি করবো’।


আপনি মুসলিমদের কথাবার্তার মাঝে অসংখ্যবার ইনশাআল্লাহ্‌র ব্যবহার দেখতে পাবেন। দৈনন্দিন কথা-বার্তায় ইনশাআল্লাহ্‌ একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে যখন কারো কাছ থেকে ইনশাআল্লাহ্‌ শোনেন, তখন অপরজন ধরেই নেন ‘কাজটি আর হচ্ছে না’। আল্লাহ্‌কে সাথে রেখে কৃত প্রতিশ্রুতি অবলীলায় ভেঙ্গে ফেলার নামই যেন ‘ইনশাআল্লাহ্‌’। একজন মুসলিম কর্মকর্তা চিৎকার করে তার অধীনস্ত সহকর্মীকে বলছে- না, না, আমি কোন ইনশাআল্লাহ্‌ শুনতে চাই না; আপনি সোজা বলুন- কাজটি করবেন কি করবেন না। তখনও সহকর্মী বলছেন- ইনশাআল্লাহ্‌। বাংলাভাষী মুসলিম সমাজে একদিকে ইনশাআল্লাহ্‌র সঠিক অর্থ ও বিশেষত্ব যেমন কখনো শিক্ষা দেয়া হয়নি, অপরদিকে এর অপব্যবহারের পরিণাম সম্পর্কেও কোন ধারণা দেয়া হয়নি।


এখন আমরা এই নিবন্ধে ইনশাআল্লাহ্‌র অবস্থান ও মর্যাদা জানার চেষ্টা করবো। একই সাথে ইনশাআল্লাহ্‌র অপব্যবহারের এক ভয়ংকর চিত্র উপস্থাপন করে মুক্তির উপায় হিসেবে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা পেশ করবো। ওয়া মা তৌফিকি ইল্লা বিল্লাহ। 
ইনশাআল্লাহ্‌র পেছনের গল্পঃ
রাসূল সাঃ এর শুরুর নবুওয়তী জীবনের শুরুতে দাওয়াতী কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় কুরাইশদের তুমুল অভিযোগ ও শত্রুতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। জাহেলিয়াতের ধ্বজাধারীরা একত্ববাদের সম্মোহনী দাওয়াতকে ভয় পেয়ে বসেছিল। মানবতার বন্ধু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে মিথ্যাবাদী, পাগল, যাদুকর বলে প্রাথমিক মানসিক আঘাত করেছিল। সেখানে সফল হতে না পেরে যেকোন কৌশলে রাসূলুল্লাহকে থামিয়ে দিতে চাইছিল। কৌশলের অংশ হিসেবে মক্কার কুরাইশরা নযর বিন হারিছ এবং উকবা বিন আবু মঈতকে মদীনার ইহুদী আলেমদের কাছে পাঠাল। তারা তাদের উভয়কে বললঃ তোমরা মদীনায় যাও এবং মুহাম্মাদ এর ব্যাপারে তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর। তোমার তাদেরকে মুহাম্মাদের গুণাগুণ সম্পর্কেও বল এবং সে যা বলছে, সে সম্পর্কেও তাদেরকে খবর দাও। কেননা তারা আহলে কিতাব। তাদের কাছে নবী-রাসূলদের সম্পর্কে এমন জ্ঞান আছে, যা আমাদের কাছে নেই।
সুতরাং নযর বিন হারিছ এবং উকবাহ মদীনায় গিয়ে ইহুদী আলেমদের কাছে রাসূল (সাঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। তারা ইহুদী আলেমদের কাছে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর বৈশিষ্ট এবং তাঁর কিছু খবরাদিও বর্ণনা করল। পরিশেষে তারা বললঃ তোমরা তাওরাতের অধিকারী। তাই আমরা তোমাদের কাছে আমাদের নবুওয়তের দাবীদার (মুহাম্মাদ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে এসেছি। সুতরাং আমাদেরকে তার সম্পর্কে কিছু সংবাদ দাও এবং এমন কিছু বিষয় শিখিয়ে দাও, যার দ্বারা আমরা তাঁকে পরীক্ষা করতে পারি।
এবার ইহুদী আলেমরা তাদেরকে বললঃ তোমরা তাঁকে তিনটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর। সে যদি ৩ টির ২ টির উত্তর দিতে পারে এবং ৩য় টির উত্তর না দেয়, তাহলে সে সত্য নবী। আর যদি ২টির উত্তর না পারে, সে একজন মিথ্যুক। তোমরা তার ব্যাপারে তখন যা ইচ্ছা তাই করতে পার।
এবার কুরাইশরা খুবই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। আব্দুল্লাহর ছেলে মুহাম্মাদকে আটকানোর মওকা পেয়ে গেছে ! মুহাম্মাদ তো আর আহলে কিতাবদের কেউ নয়; এমনকি সে অশিক্ষিত। এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয় সে দিতে পারবে না। প্রশ্ন তিনটি ছিলঃ
১) তোমরা তাকে ঐ সমস্ত যুবকদের সম্পর্কে (আসহাবে কাহাফ) জিজ্ঞেস কর, যারা অতীত কালে দ্বীন নিয়ে পলায়ন করেছিল। তাদের অবস্থা কি হয়েছিল? কেননা তাদের ঘটনাটি ছিল সত্যিই বিস্ময়কর।
২) তোমরা তাকে আল্লাহর সেই মুমিন বান্দা (যুল কারনাইন) সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর, যিনি পূর্ব ও পশ্চিমের সব দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। তার খবর কি ছিল?
৩) তোমরা তাঁকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর। এটি কি?


প্রশ্নগুলো নিয়ে নযর এবং উকবাহ মক্কার কুরাইশদের নিকট ফেরত আসল। তারা কুরাইশদেরকে বললঃ আমরা মুহাম্মাদ ও তোমাদের মাঝে ফয়সালাকারী একটি বিষয় নিয়ে এসেছি। এই বলে তারা প্রশ্নগুলো সম্পর্কে কুরাইশদেরকে জানাল এবং বললঃ মদীনার ইহুদী আলেমগণ আমাদেরকে বলেছে, আমরা যেন প্রশ্নগুলো মুহাম্মাদের সামনে পেশ করি। সুতরাং তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট আগমণ করল এবং উপরোক্ত তিনটি প্রশ্ন করল। তিনি বললেনঃ ‘আগামীকাল আমি তোমাদেরকে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিব’। কিন্তু তিনি ইনশাআল্লাহ্ বলতে ভুলে গেলেন। কাফেররা আগামীকালের ওয়াদা নিয়ে চলে গেল। ইনশাআল্লাহ্ না বলার কারণে ১৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরও এ ব্যাপারে কোন অহী আসল না এবং জীবরাইল (আঃ) আগমণ করলনা।
ঐ দিকে মক্কার কুরাইশরা বলাবলি করতে লাগলঃ মুহাম্মাদ আগামীকালের ওয়াদা করেছে। আর আজ ১৫ দিন হল। এখন পর্যন্ত আমাদের প্রশ্নগুলোর কোন উত্তরই দিতে পারে নি। এতে রাসূল (সাঃ) চিন্তিত হলেন এবং বিষয়টি তাঁর কাছে কঠিন আকার ধারণ করল। অতঃপর ১৫ দিন পর জীবরাইল (আঃ) সূরা কাহাফসহ অবতীর্ণ হলেন। তাতে আসহাবে কাহাফের ঘটনা, যুল কারনাইন বাদশার ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আছে এবং এই সূরাতে ৩য় প্রশ্ন রুহ সম্পর্কে কোন আলোচনা নেই। আল্লাহ্‌র রাসূল পরীক্ষায় উৎরে গেলেন।


এই সূরার ২৩ ও ২৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা পরিস্কার ভাষায় রাসূল (সাঃ) সতর্ক করে দিয়ে বললেনঃ “আপনি কোন কাজের বিষয়ে বলবেন না যে, সেটি আমি আগামী কাল করব। ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে’ বলা ব্যতিরেকে। যখন ভুলে যান, তখন আপনার পালনকর্তাকে স্মরণ করুন এবং বলুনঃ আশা করি আমার পালনকর্তা আমাকে এর চাইতেও নিকটতম সত্যের পথ নির্দেশ করবেন।’’ 
এই আয়াতের মাধ্যমেই ইনশাআল্লাহ্‌ শব্দের মর্যাদা সুরক্ষিত হয়েছিল এবং তখন থেকেই এটি মুসলমানদের প্রিয় উক্তি। আমরা ইনশাআল্লাহ্‌ পেয়েছি আল কুরআনের পবিত্র আয়াতের মাধ্যমে। সূতরাং এই শব্দের মর্যাদা-সম্মান নিয়ে আর কোন আলোচনা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না।
কেন ইনশাআল্লাহ্‌?
ইসলামিক স্কলারবৃন্দ ইনশাআল্লাহ্‌ বলার ৩ টি যৌক্তিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন যা শব্দটিকে অসাধারণত্ব এনে দিয়েছে।


একঃ যখন আমরা বলি- “আমি কাজটি আগামীকাল করবো’- তখন টেকনিক্যালি মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়। পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে বাস্তবতার নিরিখেই অনেক সময়ে এমনকিছুর মুখোমুখি হতে হয়, যেখানে আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তখন স্বভাবতই সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু টেকনিক্যালি চিন্তা করলে আমি প্রতিশ্রতি ভঙ্গ করলাম এবং আগের দিন মিথ্যা বলেছিলাম বলে প্রমাণিত হলাম। কিন্তু ইনশাআল্লাহ্‌ বলার মাধ্যমে আমার নিয়ন্ত্রণের বাহিরের অপারগতার কারণে দায়মুক্তি পেতে পারি; অন্তত মিথ্যাচারী সাব্যস্ত হওয়া থেকে মুক্তি পেতে পারি।


দুইঃ ধরুন আমরা একটি কর্মব্যস্ত আগামীকালের গোছালো পরিকল্পনা আঁকলাম। অনেক কাজ, অফিসিয়াল মিটিং, ক্লায়েন্ট ডিলিং, ফ্রেন্ডস পার্টি, একাডেমিক ও প্রফেশনাল অধ্যয়ন, প্রিয়জনের সাথে কিছুক্ষণ। আগামীকাল ঠিকই আজকের দিন হয়ে সামনে চলে আসলো কিন্তু বাস্তবিক ও যৌক্তিক কিছু কারণে শিডিউল ও টাইমিং ঠিকঠাক হলো না। কিছু পরিকল্পনা বাদ দিতে বাধ্য হতে হলো। দিনশেষে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের হিসেব কষতে বসে হতাশ ও বিমর্ষ হতে হলো। গতকাল যা পরিকল্পনা নিয়েছি তার অনেক কাজই তো করতে পারিনি। কিন্তু পরিকল্পনা নেয়ার সময় যদি আল্লাহর কাছে সহযোগীতা ও সামর্থ চেয়ে ইনশাআল্লাহ্‌ বলে সামনে এগিয়ে যাওয়া হতো, তখন অবাস্তবায়িত পরিকল্পনার তালিকা হাতে নিয়ে শান্ত মাথায় ভাবনারা এসে বলতো- আল্লাহ চাননি তাই এসব কাজ হয়নি এবং আল্লাহ্‌ যেভাবে আজ দিন কাটিয়েছেন তাতে আলহামদুলিল্লাহ। হতাশ না হয়ে তখন অসমাপ্ত কাজের সমাপ্তিকল্পে পরবর্তী দিনের দৃঢ় পরিকল্পনায় ডুব দিব। 
তিনঃ যখন আমরা ইনশাআল্লাহ্‌ বলি- তখন আল্টিমেটলি আল্লাহ্‌ তায়ালার কাছে আমাদের গৃহীত পরিকল্পনার বাস্তবায়নের অনুমতি প্রার্থনা করি এবং কাজটি সফলভাবে সম্পাদনের দায়িত্ব বান্দা ও মালিক উভয়ের জিম্মাদারীতে ঠেলে দিই। কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের এমন বিনয়ী আকাঙ্ক্ষা এক আধ্যাত্মিক উন্মেষ এনে দেয়।


এই হলো ইনশাআল্লাহ্‌ বলার যৌক্তিক কারণ এবং বাস্তবতা। এখন দেখবো- কিভাবে আমরা এই পবিত্র শব্দের অপব্যবহার করি। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে ইনশাআল্লাহ্‌র যথার্থ প্রয়োগ থেকে কতদূরে আছি। নিজের জিজ্ঞাসা করতে হবে কেন এসব হচ্ছে? কেন আমরা ইনশাআল্লাহ্‌র অপব্যবহার করছি?
ইনশাআল্লাহ্‌র অপব্যবহার


প্রত্যেকেই ‘না’ বলতে অপছন্দ করেন। ‘না’ বলার মাধ্যমে অশ্রদ্ধাবোধ ও অসম্মান প্রকাশ পায় বলে এক ধরনের হাইপোথেসিস তৈরী আছে। অন্যের কাছে নিজের ব্যক্তিত্ব বিনষ্ট হয়। আমরা সবাই ই ‘না’ বলা থেকে মুক্তি চাই। ঠিক এ জায়গাতেই মুসলমান হিসেবে আমরা একটা দারুন সুবিধা (Advantage) পাই। আমরা ‘না’ থেকে বাঁচতে অত্যন্ত চৌকস একটি শব্দ ‘ইনশাআল্লাহ্‌’ ধর্মীয় উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে আছি। সরাসরি ‘না’ বলা কঠিন; তাই বলে দিই ‘ইনশাআল্লাহ্‌’। এটা আমাদের দায়মুক্তির দিগন্ত উন্মোচন করে দেয়। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে বলতে পারি- আমার তো কাজটি করার ইচ্ছে ও আগ্রহ ছিলই; কিন্তু আল্লাহ্‌ চাননি তাই করতে পারিনি। এভাবে আমরা মানসিকভাবে তৃপ্ত থাকার রসদ খুঁজি। অনুতপ্ত হৃদয়ের বদলে আমরা যুক্তিপ্রবণ হৃদয়কে প্রতিস্থাপন করি।


এবার চলুন একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গভীরভাবে চিন্তা করি। ‘ইনশাআল্লাহ্‌’ বলে যখন আমরা কোন আসন্ন কাজে যথাযথ আগ্রহ, উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার ঘাটতি রাখি অথবা ন্যূনতম কোন দূর্বলতা প্রদর্শন করি, তখন প্রকারান্তরে আল্লাহ্‌ তায়ালাকেই উপেক্ষা করি। কেন? কারণ, ‘ইনশাআল্লাহ্‌’ বলে আমরা কোন কর্ম সম্পাদনের প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরে যখন তা বাস্তবায়নের জন্য কোন প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ নিই না কিম্বা নামেমাত্র সামান্য প্রচেষ্টা নিই, তখন বাই ডেফিনেশন আমরা আমাদের দূর্বলতার জন্য আল্লাহকেই দোষারোপ করি। আল্লাহ্‌ চাইলে তো হতো, আল্লাহ্‌ চাননি তাই হয় নি বলে আমরা কত বড় কথা বলছি তা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছি? আল্লাহ্‌ কিভাবে কাজ করাতে চান, কিভাবে চান না- তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করি আমাদের প্রচেষ্টাহীন অলস ভূমিকার উপর ভিত্তি করে।


মুসলমান হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও পছন্দের ক্ষমতা দান করেছেন। মহান রব কর্ম সম্পাদনের নিমিত্তে হৃদয়-মন ও শরীরকে ব্যবহার করার স্বাধীনতা দিয়েছেন। যদি কোনকিছু আমাদের সামর্থ ও নিয়ন্ত্রণের বাহিরে যায় এবং তার দরুন আমরা প্রতিশ্রুত কাজের আঞ্জাম দিতে না পারি, তাহলে বিশ্বাস করে নিতে হবে নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তায়ালা এই কাজটির জন্যে আমাকে কবুল করেন নি। এই অপারগতার মাঝেই আমার জন্য কল্যান আছে। কিন্তু যেখানে আমার কোন উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় ছিল না, সেখানে কিভাবে আল্লাহ্‌র ইচ্ছে/অনিচ্ছা নিয়ে কথা বলে নিজের দায়মুক্তি খুঁজি?
ইনশাআল্লাহ্‌র অপব্যবহার রোধে করে আসুন ‘না’ বলা শিখি :


মুসলিম হিসেবে আমাদের ইনশাআল্লাহ্‌ শব্দের ব্র্যান্ডিং নতুন করে শুরু করতে হবে। আমাদের এমন এক প্রান্তবিন্দুতে পৌছতে হবে যেখানে ‘ইনশাআল্লাহ্‌’ শব্দ শুনলে পৃথিবীবাসী বিশ্বাস করবে-‘হ্যাঁ, নিশ্চয় কাজটি হবে’। আমরা যখন ‘ইনশাআল্লাহ্‌’ বলবো তখন মানুষ আস্থার এক অনুপম পরশের ছোঁয়া পাবে। আমার ইনশাআল্লাহ্‌ অর্থ হচ্ছে- আল্লাহ্‌ চাহে তো সম্ভব সবটুকু ঐকান্তিকতা দিয়ে এই কাজটি করবো। এই আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি করতে হলে ইনশাআল্লাহ্‌ বলার অভ্যাসের সাথে সাথে পরিস্থিতির বাস্তবতায় ‘না’ বলার হিম্মত, সাহস ও যোগ্যতা অর্জন বাঞ্চনীয়। একজন মুসলমান সবসময় কোমল, বিনয়ী, ভদ্র হবে নিশ্চয়ই, একই সাথে স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড হওয়াটাও তার নৈতিক গুণ।


প্র্যাকটিক্যাল মুসলমান হিসেবে একটি কথা খুব সহজভাবে কবুল করে নিতে হবে যে- ‘না’ বলা মানেই অসৌজন্যতা, অসম্মান, অশ্রদ্ধা ও আনুগত্যহীনতা নয়। ইনশাআল্লাহ্‌র অপব্যবহার বন্ধ করতে বিনম্র ‘না’ মুসলিম মানসে অবশ্যই খুব স্বাভাবিকভাবে প্রোথিত হতে হবে। আমরা এখন ইনশাআল্লাহ্‌র পরিবর্তে ‘না’ বলার ৩ টি কৌশল আলোচনা করবো।


সময়ক্ষেপণ কৌশলঃ আপনার প্রিয়তম বন্ধু আগামীকাল দুপুরে তার সন্তানের আকিকা উপলক্ষে লাঞ্চের দাওয়াত দিল। সম্পর্কের গভীরতায় না বলা কঠিন, আবার অফিস টাইমে ছুটিও পাওয়া কঠিন। পরিস্থিতি সামলে নিতে ফোনে ইনশাআল্লাহ্‌ না বলে বিনয়ের সাথে বলি- অফিসে বসের সাথে কথা বলে তোমাকে জানাতে পারলে আমার জন্য এহসান হতো। অর্থাৎ কাউকে তাৎক্ষনিক ইনশাআল্লাহ্‌ বলার চেয়ে একটু সময় নিয়ে ফিডব্যাক দিই। তাহলে অগ্র-পশ্চাৎ অনেককিছু ভেবে প্র্যাকটিক্যাল সিদ্ধান্ত দিতে পারবো। অভ্যাসবশত ইনশাআল্লাহ্‌ না বলে সচেতনভাবে ইনশাআল্লাহ্‌ বলি। সরাসরি কারো মুখের উপর না বলতে না পারলে সিদ্ধান্তের ব্যাপারে একটু বিলম্ব করি। তাতে প্রতিশ্রুতি গ্রাহক বাস্তবতা কবুল করার ফুসরৎ পাবেন; একই সাথে আমিও সচেতনভাবে ইনশাআল্লাহ্‌/ না বলার সুযোগ পাবো।


প্রতিস্থাপন কৌশলঃ অফিসের বস একেবারে নতুন এক প্রজেক্টে আমাকে পাঠাতে চাইছে। খুব স্বভবতই আমরা সেখানে যেতে চাইবো না। নতুন প্রজেক্ট সম্পর্কে অনভিজ্ঞতা এবং নতুন কর্মক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জ নিশ্চয় ভীতির সৃষ্টি করবে। বসের নির্দেশের মুখে অনিচ্ছা স্বত্বেও ইনশাআল্লাহ্‌ না পড়ে নিজের সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করবো। বলতে পারি- আমি সম্ভবত এই নতুন প্রজেক্টের জন্যে পারফেক্ট নই। কারণ............। সুযোগ থাকলে সহকর্মীদের মধ্যে স্পেশালিষ্ট কাউকে সাজেস্ট করবো।


ঠিক এভাবে উর্ধ্বতন কারো নির্দেশনাকে সরাসরি না বলতে পারলে আশেপাশের বিকল্প সমাধান উপস্থাপন করা যেতে পারে। আর পরিস্থিতি সামলে নেয়ার সুযোগ থাকলে বিনয়ের সাথে নিজের অনিচ্ছার কথা স্বীকার করাটা অধিক কল্যানের। তবে একজন মুসলমান কখনো কথা চেপে রেখে বাধ্য হয়ে ইনশাআল্লাহ্‌ বলে পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট কাজে গাফলতি ও অনাগ্রহ প্রদর্শন করতে পারেন না। ইনশাআল্লাহ্‌ বলার অর্থই হচ্ছে- সর্বোচ্চ মনোযোগ ও প্রচেষ্টা। কোন কাজ পছন্দসই না হলে বলা যেতে পারে ‘আমি চেষ্টা করছি’; তবে কোনভাবেই ইনশাআল্লাহ্‌ নয়।


সংকোচন কৌশলঃ প্রফেশনাল একটি মিটিং এ আমাকে ইনভাইট করা হলো। ৩ ঘন্টাব্যাপী মিটিংয়ে আমার সাথে রিলেটেড আলোচনা ৩০ মিনিট। আমার অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে অযথা ৩ ঘন্টা মিটিংয়ে বসে থাকার যৌক্তিকতা নেই। এমতাবস্থায় ইনভাইটরকে ইনশাআল্লাহ্‌ না বলে বলবো- আমি মিটিংয়ের এই শেষনে থাকতে চাই; কারন শেষনটি আমার জন্যে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ পুরো ইনশাআল্লাহ্‌র অর্থ যেন বিকৃত না হয়। কাউকে যখন প্রতিশ্রুতি দিব, তখন ইনশাআল্লাহ্‌, ইনশাআল্লাহ্‌ না বলে সুনির্দিষ্ট কথা বলে প্রতিশ্রুতিকে সংকোচিত/লাঘব করা যেতে পারে।


না বলা কঠিন কিছু নয়। কিছুদিন অনুশীলন করতে পারলেই এটি সহজাত গুণ হয়ে উঠবে। সত্যি বলতে কি ইনশাআল্লাহ্‌ বলে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার চেয়ে না বলার মহৎ গুণকে সকলে স্বাগত জানাবে এবং যে কারো ব্যক্তিত্বের পরিচ্ছন্নতাকে প্রকাশ করবে।


কিভাবে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অধীনস্তদের ইনশাআল্লাহ্‌র উপর দণ্ডায়মান রাখতে পারেন?
ব্যক্তি উদ্যোগে ইনশাআল্লাহ্‌র সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত এবং তার ব্রান্ডিং করার প্রচেষ্টা খুব কমই প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। তাহলে কিভাবে ইনশাআল্লাহ্‌র ব্রান্ডিং হবে? কিভাবে ইনশাআল্লাহ্‌র মর্যাদা অটুট থাকবে? এখন আমরা সেটিই বলবো। ব্যক্তির চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক/সাংগঠনিকভাবে ইনশাআল্লাহ্‌র স্ট্যাটাস বজায় রাখার অনুশীলন করলে তা একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিবে। বিশেষ করে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইনশাআল্লাহ্‌র সঠিক চর্চা নিশ্চিত এবং অপব্যবহার রোধ করতে হবে। প্রতিষ্ঠান/সংগঠনের উর্ধ্বতনদের পক্ষ থেকে পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ইনশাআল্লাহ/না উভয় অপশন খোলা রাখতে হবে। 
একঃ ইনশাআল্লাহ্‌র ব্যাপারে সবাইকে প্রকৃত শিক্ষা দেয়া দরকার। অফিস, সংগঠনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবশ্যই অধীনস্তদের ইনশাআল্লাহ্‌র প্রকৃত হক ও দাবী শিক্ষা দিবেন। ইনশাআল্লাহ্‌ বলার অর্থ কি তা না জানলে গণহারে ইনশাআল্লাহ্‌ বলা অব্যাহত থাকবে আর প্রতিশ্রুতি ভাঙ্গতেই থাকবে। ইনশাআল্লাহ্‌র অপব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করা দরকার। বুঝানো দরকার ইনশাআল্লাহ্‌র সঠিক ব্যবহারের নৈতিক দায়বদ্ধতার পাশাপাশি তার অপব্যবহারে ব্যক্তিত্বর চারিত্রিক ত্রুটি দৃশ্যমান হয় এবং প্রতিষ্ঠান/সংগঠনের প্রোডাক্টিভিটি ক্ষুণ্ন হয়। উর্ধ্বতনরা ইনশাআল্লাহ্‌র অপব্যবহার দেখলে অধীনস্তদের অবশ্যই ফিডব্যাক দিবেন। প্রয়োজনে ইনশাআল্লাহর অপব্যবহারকারীকে শাস্তি এবং সঠিক ব্যবহারকারীকে পুরস্কিত করা যেতে পারে।
দুইঃ উর্ধ্বতনদের পক্ষ থেকে অধীনস্তদের না বলার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। অনেক প্রতিষ্ঠানে ‘না’ বলার অর্থ হচ্ছে ‘ক্যারিয়ার সুইসাইড’ করা। সংগঠনের নেতাদের মুখে না করার অর্থ ‘আনুগত্যহীন’ বলে বিবেচিত হওয়া। অধীনস্তদের এই চাপ থেকে মুক্তি দিতে হবে। ‘ না’ বলা ইনশাআল্লাহ্‌ বলে মিথ্যাচারের চেয়ে উত্তম।


শেষকথাঃ 
ইনশাআল্লাহ্‌ সত্যিই এক দারুণ শব্দ। জেনেবুঝে ইনশাআল্লাহ্‌ বলার মাধ্যমে কর্মসম্পাদনকামী বান্দা ও তার প্রভূর মাঝে এক ধরনের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বন্ধন তৈরী হয়। এই স্পিরিট কর্মসম্পাদনে দায়বদ্ধতা এনে দেয়। কুরাআনুল কারীমের মাধ্যমে নাযিলকৃত এই পবিত্র শব্দের অপব্যবহার একদিকে আমাদের ব্যক্তি হিসেবে ক্ষতিগ্রস্থ করে, অপরদিকে মুসলিম ব্রান্ডে সজোরে আঘাত হানে। আমরা সীমাবদ্ধতা নিয়ে ‘আল ইসলাম’ এর বড় কোন খেদমত করতে না পারলেও ইনশাআল্লাহ্‌র মুসলিম ব্র্যান্ডিংয়ের গায়ে কোন কালিমা লাগানো থেকে অন্তত হেফাজত করতে তো পারি। আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন। 
তথ্যসূত্রঃ 
• আল কুরআনঃ সূরা কাহফ- ২৩/২৪
• তাফসীরে ইবনে কাছীর- সূরা কাহাফের পটভূমি
• তাফসীরে মা’আরেফুল কুরআন- সূরা কাহফের পটভূমি
http://www.produvtivemuslim.com- An article on Let’s restore the dignity of InshaAllah
• নিউইয়র্ক টাইমস – An article on InshaAllah is good for everyone. 
• মাসিক আল কাউসার- এপ্রিল ২০১২ সংখ্যা


এলকোহল নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনের কথা

দুটি ব্যাপার আমার কাছে ডিসগাস্টিং। প্রথমটি হলো- ইসলামের বিধানাবলীকে বিজ্ঞানের দাঁড়িপাল্লায় মেপে তার যৌক্তিকতা পরিমাপ করার বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। আর দ্বিতীয়টি হলো- ইসলামের বিধানাবলীর প্রানসত্বাকে উপস্থাপন না করে সেই বস্তুবাদী দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মেপে প্র্যাক্টিক্যালিটি প্রমাণের লক্ষ্যে ওলামায়ে কিরামের হিপোক্রেসি।

এই যেমন আলেম-ওলামাদের নিকটে 'ইসলামে এলকোহলের নিষেধাজ্ঞার (হারাম) বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা কি' প্রশ্ন করলে কমন উত্তর পাবেন- মেডিকেল সাইন্সেই প্রমাণিত হয়েছে এলকোহল স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর। ইসলাম মানবিক ধর্ম, বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম- তাই এই ক্ষতিকর ব্রেণ ধ্বংসকারী এলকোহল ইসলামে নিষিদ্ধ। প্রশ্নটিই আমার কাছে অবান্তর। এলকোহলের নিষেধাজ্ঞার "বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা" একজন মূমীনের প্রশ্ন হতে পারে না এবং ইসলাম বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যার কাছে যিম্মী নয়। আর এই প্রশ্নের উত্তরে "বিজ্ঞানসম্মত উত্তর" দিতে গিয়ে ইসলামের প্রানসত্ত্বাকে উপেক্ষা করার হিপোক্রেসিও অবাঞ্চিত ব্যাপার।

এখন আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে- স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর শুধু এ কারনেই এলকোহল নিষিদ্ধ হয়েছে? এলকোহল নিষিদ্ধের কারণ স্বাস্থ্যক্ষতি অথবা মানসিক ভারসাম্যহীনতা- এ ব্যাপারে রেফারেন্স পেলে আমি স্বস্তি পেতাম।

এলকোহলের ব্যাপারে ইসলামের প্রানসত্বার ঘোষণা কি? আমি যদি এভাবে বলি- এলকোহলের সাথে ''তাওহীদ তথা একত্ববাদ" এর সেন্সিটিভ প্রশ্ন জড়িয়ে আছে বলেই আলকোহল নিষিদ্ধ- তাহলে কি আপনি আমাকে মেহেরবানী করে ভুল প্রমাণিত করে ভ্রান্তি দূর করবেন প্লিজ?

এলকোহলের সাথে তাওহীদ কিভাবে লিংকড? জানবো একটু পরেই ইনশাআল্লাহ্‌। তার আগে আপনার মানসে বাসা বাঁধা চিন্তার দিকে খেয়াল করুন। এলকোহলিক ব্যক্তি নেশাগ্রস্থ হয়, উন্মাদ হয়, বুদ্ধি-বিবেক হারিয়ে ফেলে। রাইট? আপনি ভাবছেন এসব থেকে মুক্তির জন্যেই এলকোহল প্রোহিবিটেড। ওয়েল। আপনি জানেন নির্দিষ্ট মাত্রার এলকোহল এসব উন্মাদনা, নেশার সৃষ্টি করে না। তাহলে কি আল্লাহ্‌র রাসূল বলতেন না- তোমরা এক ঢোকের বেশী এলকোহল খেও না। এমন মাত্রায় খেও যেন নেশাগ্রস্থ হয়ো না। (নাউজুবিল্লাহ)। না, আমাদের দ্বীন আল ইসলামে এক বোতল এলকোহল নেয়া আর এক গ্লাস নেয়া একই কথা।

এবার আমরা তাওহীদের সাথে এলকোহলের লিংক খুঁজার আগে একটি সহীহ হাদীস জেনে নিই। আল্লাহ্‌র রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ مَنْ لَقِيَ اللَّهَ مُدْمِنَ خَمْرٍ لَقِيَهُ كَعَابِدِ وَثَن অর্থাৎ “ যে ব্যক্তি এলকোহলিক অবস্থায় মারা যাবে, (কিয়ামতে) সে একজন মূর্তিপূজকের ন্যায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে”।
কেন? এলকোহলিক মূর্তিপূজকের ন্যায় কেন? লিংক এখানেই। মূর্তিপূজকরা যেমন এক আল্লাহ্‌র তাওহীদে অটুট না থেকে একাধিক ইলাহতে পূজা করেছে; ঠিক তেমন এলকোহলিকরা এক আল্লাহ্‌র সীমারেখার বাহিরে এলকোহলের দাসত্ব করেছে। এটাই লিংক। এলকোহলিকের সাথে মূর্তিপুজকের এটাই মিল।

আল্লাহ্‌ তার বান্দাকে কেবলমাত্র তার দাসত্ব করাতে চান। আল্লাহ্‌র বাহিরে কারো দাসত্ব করা হারাম। এলকোহল এমন এক প্রভূ হয়ে যায়, যেখানে এলকোহলিকরা তার আনুগত্য না করে পারে না। প্রতিদিন এলকোহল না খেলে চলে না। এলকোহল খেয়ে প্রবৃত্তির দাস না হয়ে থাকা যায় না। এন্ড দ্যাটস দ্যা রিজন বিহাইন্ড প্রোহিবিটেশন অব এলকোহল।

তাওহীদের বিপরীতে এলকোহলিক শিরক করে এবং এটিই এলকোহল হারাম হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ। ইসলামের এই প্রানস্ত্বার কথা না বলে কেবলমাত্র স্বাস্থ্যগত বেনিফিট দিয়ে এলকোহলিক ফ্রি জেনারেশন বিল্ডাপ করা সূদুর পরাহত ব্যাপার এবং এটাকে আমি আলেমদের জ্ঞাণের দৈণ্যতা ও হিপোক্রেসি বলে বিবেচনা করি (ব্যতিক্রমী আলেমে দ্বীন অবশ্যই আছেন এবং আমি তাদের হৃদয়ের গহীন থেকে ভালবাসি।)।

আল্লাহ্‌ আমাদের দ্বীনের সত্যিকারের জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে তার দাসত্ব করার তৌফিক দিন। বারাকাল্লাহ।

সোস্যাল মিডিয়াতে আসলে কি লিখবো?

পরিচিত অনেকজনকে ফেসবুক ডিএকটিভ করে দিতে দেখছি। অনেকেই ভাবছে। 
পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে আমিও সে ভাবনার কাছাকাছি। তবে নিশ্চিত আমি ফেসবুক বন্ধ করে থাকতে পারবো না। আর থাকতে পারবো না বলেই আজ কিছু কথা বলছি। বিনয়ের সাথে ক্ষমাপ্রার্থী।

এক,
বড় সংকট হলো- ফেসবুককে আমরা ব্যক্তিগত ডায়েরী ভেবে বসি। খেয়াল করে দেখবেন- "ডায়রী'' টার্মের চেয়ে "ব্যক্তিগত ডায়েরী" টার্মটিই বহুল পরিচিত। ব্যক্তি "আমি" কে ডায়রীতে লিখে রাখলে, তাতে অন্যে কারো এক্সেস থাকে না। ফেসবুক এখানেই ডিফার করে। ফেসবুককে পড়ার টেবিলের বইয়ের গাঁদার নিচে লুকিয়ে রাখা যায় না। সোস্যাল নেটওয়ার্ক। এটা একটা উন্মুক্ত মঞ্চ। হাজারো শ্রোতা, হাজারো দর্শক। আপনি যা লিখছেন, বলছেন, আপলোড করছেন- তা হাজারো মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। ওপেন ওয়ার্ল্ড। আজ থেকে ৫ বছর আগে শুধু উঁচু তলার লোকেরা মাইক্রোফোনের এক্সেস পেত; জুকারবার্গের যুগান্তকারী সৃষ্টির কল্যাণে আজ আমি-আপনি ১০/২০ হাজার মানুষের কাছে পৌছার এক্সেস পেয়েছি। এখন আর কেউ কাউকে দাবায়ে রাখতে পারবে না।

দুই,
জীবনকে আপনি কিভাবে দেখেন। গ্লাসের অর্ধেক পানিতে ভরা আর অর্ধেক খালি ফাঁকা। আপনাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়- গ্লাসে কি ? আপনার জীবন দর্শনই ঠিক করে দিবে উত্তর। অপটিমিষ্টিক, পজেটিভ হার্ট খুব ন্যাচার‍্যালী বলে উঠবে অর্ধেক পানিতে ভরপুর গ্লাস। আর হতাশার সাগরে সাঁতরে বেড়ানো কুঁকড়ে যাওয়া নেগেটিভ হৃদয় সেখানে কেবল অর্ধেক খালি গ্লাসই দেখতে পাবে। সত্যিই স্রষ্টার ইচ্ছায় বাই চয়েজ ডেভেলপিং কান্ট্রিতে জন্ম নেওয়া আমরা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার মুখোমুখি। এখানে আকাশের নিচের অধিকাংশ বনি আদমকেই প্রতি নিয়ত টিকে থাকার লড়াই করতে হয়। ভালবাসার রংয়ের চাদরে মোড়া শৌখিন খাটের গল্প এখানে খুবই কম সংখ্যক মানুষের জীবনের সাথে মিলে। কষ্টের সেতু পাড়ি দিয়েই দুঃখ নদীর স্রোত। সে স্রোতে কত মাঝিই পথ হারায়? আর অকুতোভয় যাত্রীরা ভয়ংকর স্রোত পাড়ি দিয়ে তীরে উঠতেই বাঘ, সিংহ, সর্প আক্রমন করতে হা করে থাকে। ক্ষুধা আর দারিদ্রতা যেন আমাদের নাছোড়বান্দা প্রেমিক/প্রেমিকা ! এখানে একটুখানি প্রাপ্তির শীতল হাওয়া শত অপ্রাপ্তির গরম মিছিলে নিমেষেই উবে যায় ! এখানে স্বপ্নেরা অধরা বরাবরই।

তিন, 
এখন আপনি কিভাবে সোস্যাল নেটওয়ার্কে নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করবেন? স্বস্তিহীন, প্রাপ্তিহীন, হতাশাগ্রস্থ, অশান্তচিত্ত হৃদয়কে? না কি এর মাঝেই জীবনকে উপভোগ করার রসদ খুঁজে নিবেন? প্রতি স্ট্যটাসে বেদনার নীল ছড়াবেন, না কি আশার মশাল বয়ে নিয়ে চলবেন? একটি ক্লান্ত, বিষন্ন, অসহায় জীবনের মুর্ত প্রতীক হবেন, না কি সাবলীল, স্মোথ, উপভোগ্য জীবনের ইতিহাস লিখবেন? আমি বিনয়ের সাথে বলি- ব্যক্তি জীবনকে এভোইড করে ইউনিভার্সাল ইস্যুতে লিখুন, বলুন, ভাবুন। এই জীবনে লিখার ইস্যুর কি শেষ আছে বলুন? বিশেষ করে, আমাদের দেশ ও সমাজব্যবস্থা তো "অব্যাহত ইস্যুর জনক"। প্রত্যেকের জীবনেই অপ্রাপ্তি আছে। আমার-আপনার-সকলের। সেটি ফেসবুকে লিখলে প্রাপ্তির ঘরে চলে আসে না। বরং অন্যেরা আপনার ব্যক্তিত্বের দূর্বল পার্টসকে লোকেট করে ফেলে। জীবনকে শুধু 'আমি' নামক সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে না দেখে গ্লোবাল পারস্পেকটিভে দেখুন। আমার ছোট্ট অবজার্ভেশন হচ্ছে- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী ও ভোগবাদী শব্দ হলো- "আমি''।

চার, 
একবার ভাবুন- ফেসবুকে আপনার যারা ফ্রেন্ডস ও ফলোয়ার, তারা আপনার মাঝে জ্যোৎস্নার আলোয় ভরপুর এক অনিন্দ্য সুন্দর জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখতে চান। আপনার প্রশান্ত চিত্ত আত্মাকে উপলব্ধি করতে চান। এই সহজাত আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে সর্বদা নিজেকে হীনমন্য করে উপস্থাপন করলে, আপনার বন্ধুরা কষ্ট পান, আশাহত হোন। ভার্চুয়াল দুনিয়াতেও কষ্টেরা এসে তখন প্রাসাদ গড়ে। বাস্তবিক জীবনে কষ্টের পাহাড়ে থাকতে পারেন, তাই বলে ভার্চুয়াল জগতেও এত কষ্টের নীল ছড়িয়ে কি লাভ বলুন? সবাই ফিল করে ভার্চুয়াল জগৎ আনন্দে ভরপুর। বি পজেটিভ। রাইট পজেটিভ। মেক এ পজেটিভ ইন্টারফেস!

পাঁচ, 
আমি টাইমলাইনে কিছু মানুষের এই দুঃখ-গাঁথার কথা পড়তে পড়তে ক্লান্ত। ব্যক্তি জীবনে তাদের প্রাপ্তির খাতাটাও দেখেছি। কত সুন্দর তাদের জীবন। অথচ...... . 
ছোটবেলায় যখন মুনির খান, আসিফের গান শুনতাম। প্রতিটি গানের লিরিক্স অবজার্ভ করে ভাবতাম- ওনারা কতটা দুঃখী মানুষ। উফ। অঞ্জনারা এভাবে কষ্ট দিয়েছে মুনিরদের? কিন্তু আজ বড় হয়ে বুঝি- অঞ্জনা, নীলাঞ্জনাদের দেয়া 'মেকী' কষ্টকে ওনারা সফলভাবে বাংলাদেশের মানুষদের হৃদয়ে প্রোথিত করে দিয়ে বাস্তব জীবনে সূখের নদীতেই নৌকা বইছেন। আমরা সবাই আসিফ, মুনিরদের মত ব্যর্থ প্রেমের লিরিক্স লিখতে ভালবাসি। বড্ড ভালবাসি। বলা হয়- দুঃখ জিনিসটা ইলাস্টিকের মত। টানতে মজাই লাগে ! টানলেই লম্বা হয়। অনেক লম্বা। তবে প্রজ্ঞাবানরা, ততবেশী টানেন না, যতটা টানলে তা ছিঁড়ে যায়।

হ্যাপি ফেসবুকিং এন্ড ইনজয় দ্যা মুমেন্টাম :D