Saturday, December 31, 2016

জামায়াত সংস্কারঃ কিছু কথা (দ্বিতীয় পর্ব:)

জামায়াতের দর্শনগত হীনমন্যতা এবং রাজনৈতিক অস্পষ্টতা

ধরুন- ২০১৭ সালের জানুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ১৫১ আসনের অধিক পেয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সমাসীন হলো। এবার বলুন কোন কোন কাজ অগ্রাধীকার পাওয়া উচিৎ? নিজে একটা তালিকা করুন আর আরেকজনকে ঠিক একই প্রশ্ন করুন। আমি নিশ্চিত তালিকা ভিন্ন ভিন্ন হবে। কেন এমন হবে? এর কারণ হচ্ছে- জামায়াত রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে কি কি ইনিশিয়েটিভ নিবে, তার কোন একাডেমিক ও লিটারাল ডকুমেন্টস আদৌ তৈরী করে নি। কর্মীরাও জানে না- আসলে কোন ধরনের রাষ্ট্র কাঠামোর জন্যে তারা জাহেলিয়াতের সাথে লড়াই করে চলছেন।

পাঁচজন জামায়াত কর্মীকে যদি প্রশ্ন করা হয়- আপনারা আসলে কোন ধরনের রাষ্ট্র গঠন করতে চান? খেয়াল করলে দেখবেন একটি কমন উত্তর আসবে- ''ইসলামের ইনসাফপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা''। এরপরের প্রশ্ন যদি হয় সেই 'ইনসাফপূর্ণ' রাষ্ট্রের চিত্র কেমন ? দেখবেন একেকজন একেক রকমের উত্তর দিচ্ছে। রাষ্ট্রের আপামর নাগরিকদের তো নয়ই; আদতে জামায়াত তার জনশক্তিদেরও তার প্রত্যাশিত রাষ্ট্রব্যবস্থার ছবি আঁকিয়ে দেখাতে পারে নি। জামায়াত ক্ষমতায় গেলে যুবকদের জন্য কি কি উদ্যোগ গ্রহণ করবে? মোটাদাগে বলবেন- কর্মসংস্থানের সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়া হবে। কিন্তু বাংলাদেশের যুবকরা কি জানে জামায়াত ক্ষমতাসীন হলে তারা কিভাবে উপকৃত হবে? শ্রমিকরা কি জানে- তারা কিভাবে ইনসাফের সুফল পাবে? পতিতারা কি জানে- কিভাবে তাদের গ্লানিময় লাঞ্চনার জীবনের অবসান করবে জামায়াত? চোর-ডাকাতরা কি জানে- কিভাবে তাদের সমাজে পূনর্বাসন করে দেয়া হবে? দরিদ্র মানুষগুলোকে কিভাবে ক্ষুধামুক্ত করা হবে, আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে-সেটি কোথায় বিব্রত হয়েছে? কৃষকরা কি জানে কিভাবে তাদের উৎপাদিত ফসলের নায্য মুল্য নিশ্চিত করা হবে? ভোক্তারা কি জানে কিভাবে তাদের ক্রয়কৃত পণ্যমাণ নিশ্চিত করা হবে? জামায়াত ক্ষমতায় এলে নারীদের ঘরে বন্দী করে ফেলা যে অভিযোগের তীর ছোঁড়া হয়, তার বিপরীতে জামায়াত কিভাবে নারীদের সমাজে কন্ট্রিবিউট করাবে তার একাডেমিক বয়ান কোথায় আছে? জাহেলী সংস্কৃতির বিপরীতে কিভাবে ইসলামী সংস্কৃতিকে রিপ্রেজেন্ট করা হবে?

এসবের প্রশ্নের উত্তরে আপনি চিরায়ত ভঙ্গিতে বলবেন- কেন মদীনার ইসলামী রাষ্ট্র কি উদাহরণ হিসেবে সামনে নেই? আমি বলি, হ্যাঁ আছে। প্রথম কথা হলো- মদীনার সেই রাষ্ট্রের কাঠামো কয়জন নাগরিক জানে? দ্বিতীয়তঃ সময়ের ব্যবধানে এমন কিছু ইভেন্ট তৈরী হয়েছে, যার কোন বাস্তব উদাহরণ মদীনায় ছিল না। যেমনঃ অনলাইন দুনিয়া। এই সময়ে এসে অবশ্যই রাষ্ট্রের নাগরিকদের সামনে জামায়াতের ইনসাফপূর্ণ রাষ্ট্রের কাঠামো পরিস্কারভাবে তুলে ধরা দরকার। সেই কাঠামো দেখে নাগরিকরা সমর্থন করবে কি করবে না- সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। নিদেনপক্ষে কোন আদর্শের কর্মীদের সেই স্বপ্নের রাষ্ট্রব্যবস্থার একটা মডেল ছবি হৃদয়ে প্রোথিত করে দিতে হবে? আমি বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করি- জামায়াত যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই করছে, সেই রাষ্ট্রের ফ্রেম কোথায়? না কি আজতক আদৌ সেই ফ্রেম তৈরীই করা হয় নি। শুধু শুধু মোটাদাগে এক 'ইনসাফপূর্ণ রাষ্টব্যবস্থা'র ভৌত কাঠামোর ছায়ার পেছনে ছুটছে? সমর্থক কিম্বা বিরোধী সকলের কাছেই সেই ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের একটা ছবি তৈরি করে দিতে হবে। জামায়াতের কর্মী ও সমর্থকরা আদৌ জানেই না, জামায়াত ক্ষমতাসীন হলে কোন ৫ টি কাজ প্রথমে করবে, তারপরে কোন ৫ টি কাজ, তারপরে কি কি? তারমানে এক অজানা কর্মসূচীর পথে লাখো কর্মী ছুটে চলছে।

এই আলোচনায় প্রশ্ন উঠতে পারে- ইসলামী দল হিসেবে কেন নাগরিকদের সামনে ভবিষ্যত রাষ্ট্রের কাঠামো দাঁড় করানোকেই আমি এত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছি? উত্তরে বলি- জামায়াত যেহেতু নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেই আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ (অবশ্যই চূড়ান্ত ধাপ নয়) বিবেচনা করে, তখন জনগণের সামনে আপনার কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরাটা অতি জরুরী একটা ইস্যু। কেন জনগণ আপনাকে ক্ষমতার চেয়ারে বসাবে? আপনি সৎ, দূর্নীতিমুক্ত, সত্যবাদী- শুধু এ কারনেই? আপনি ছাড়াও সৎ, দূর্নীতিমুক্ত, সত্যবাদী মানুষ তো আছে। জনগণের সমর্থন পেতে হলে- এক সুস্পষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা ও মেনিফেস্টো দাঁড় করাতে হবে। সেটা নিয়ে মানুষকে কনভিন্সের দিকে যেতে হবে। মোটাদাগে কথা বললে চলবে না। ছাত্র-যুবক, বৃদ্ধ, পুরুষ-নারী, শ্রমিক-মজুর-কুলি, কৃষক, মুর্খ-শিক্ষিত, বেকার, চোর-ডাকাত, পতিতা, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিল, শিল্পী, বাউন্ডুলে- সকলের জন্য প্যাকেজ ঘোষনা করতে হবে। ক্ষমতায় আসলে সব অটো হয়ে যাবে- ধারনা যতদিন থাকবে, ততদিন ক্ষমতায় বসার সুযোগ নাও হতে পারে।

জামায়াত নিয়ে একটা বড় সমালোচনা আছে। তা হলো- জামায়াত নিজেদের মত করে, নিজেদের অভ্যন্তরে, নিজেদের পরিসরে অনিন্দ্য সুন্দর। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মানুষ জামায়াতের অনুপম আদর্শ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। বাঁকি ৯০ শতাংশ মানুষ জামায়াতকে না জেনে জঘন্য খারাপ ভেবে বসে আছে। সত্যি বলতে কি- জামায়াত এমন কোন ইনিশিয়েটিভ নিতে পারেনি, যা বৃহৎ জনগোষ্ঠির কাছে জামায়াতেকে পজেটিভলি রিপ্রেজেন্ট করবে। জামায়াতের নেতৃত্ব সৎ, দেশপ্রেমিক ও নির্লোভ- এই তথ্যগুলো জামায়াতের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত বলে আমরা ধরেই নিই সবাই বুঝি এমনই ভাবছে। জামায়াতের নেতৃত্ব বাছাইয়ের প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা যতটা উচ্ছ্বসিত ও সন্তোষ্ট- তা আদৌ সাধারণ নাগরিকদের ছুঁয়ে দিতে পারে না ( সুযোগও নেই)। সংগঠনের অভ্যন্তরে অসাধারণ গনতন্ত্রের চর্চা নিয়ে নাগরিকদের জানারও সুযোগ নেই। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত কতটা ইন্ট্রোভাট (অন্তর্মুখী), তা খোলা চোখে দেখার সময় এসেছে। এটা তো সত্য ব্যবসা, চাকুরী, বিয়ে, সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা একটা নিজস্ব জগত তৈরী করে ফেলেছি। যেখানে অন্য কারো এক্সেস একেবারেই সীমিত। অথচ আল ইসলামের শ্বাশ্বত সার্বজনীনিতাকে আমরা একাডেমিক্যালি অনেক বেশী হাইলাইটস করি।

এবার দর্শনগত একটা বড় গলদ নিয়ে কথা বলার ঝুঁকি নিচ্ছি। ঝুঁকি এই অর্থে বলছি- এটা আমার ব্যক্তিগত ভাবনা। আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি। প্রত্যেকটি ইসলামী দল দাবী করে রাসূল সাঃ এর সেই ইসলামী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ধরে আজ আমরা সংগঠনে সংঘবদ্ধ। এখানে একটা সূক্ষ্ম ব্যাপার আছে। রাসূল সাঃ এর ইসলামী আন্দোলন শুধুমাত্র আল ইসলাম ছিল। অন্য কোন দল, সংগঠন ছিল না। রাসূল সাঃ একমাত্র নেতা এবং তার নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ ছিল। এক জামায়াত- আল ইসলাম। কিন্তু এখন একই জনপদে অনেক ইসলামী সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেকেই তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতে বিশ্বাসী। সকলেই আল্লাহকে রব বলে, রাসূল সাঃ কে নেতা বলে মেনে নিয়েছে। প্রত্যকেই দাবী করে তারা রাসূলের সেই আদর্শের পতাকাবাহী। প্রত্যেকের দাবিই সত্য বলে ধরে নিয়ে আল ইসলামের জন্য সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করছেন বলে সফটলি ভাবার সুযোগ আছে। কিন্তু আল ইসলামের ''লা তাফাররাকু'' তাতে কতটা অক্ষুণ্ণ থাকে তা নিয়েও ভাবনার দুয়ার খোলা রাখতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে উপলব্ধি করি- আল ইসলামে কোন দল, সংগঠন নেই। সবাই মিলে আল ইসলামের পতাকাবাহী। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে- তাহলে জামায়াত কি দল হিসেবে ''লা তাফাররাকু'' ভায়োলেট করছে? 'জামায়াতে ইসলামী' নামে দলের অস্তিত্ব মানেই অন্যান্য ইসলামী দলের মাঝে এক বিভাজন তৈরী হয়ে যাচ্ছে কি? আমি বলি- না। মোটেই তা না। তবে এই জায়গাতে একটু কারেকশন আছে। জামায়াত মানেই বুঝতে হবে আল ইসলামের বটবৃক্ষ। আল ইসলামের ভেতরে কেউ অর্থনীতি নিয়ে কাজ করবে, কেউ সংস্কৃতি নিয়ে, কেউ শিক্ষা নিয়ে, কেউ ব্যবসা নিয়ে, কেউ তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে। ঠিক এভাবেই কেউ রাজনীতি নিয়ে কাজ করবে। ''রাজনীতি ও আল ইসলাম'' দুটোই হুবহু এক জিনিস- এই দর্শন নিয়ে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে। আমি স্পষ্টতঃ একটা কথা বুঝি- আল ইসলামের কোন দল নেই- তবে ইসলামী অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতির মত রাজনীতিও একটা বড় ক্ষেত্র। জামায়াতকে আল ইসলামের পতাকাবাহী করে গড়ে তোলা অপরিহার্য। সেই আল ইসলামের পতাকাবাহী জামায়াতের একটা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থাকতে পারে ( এবং অবশ্যই থাকতে হবে।)। জামায়াত সকল সেক্টরের মাদার অর্গানাইজেশন। জামায়াতের শিক্ষা সংগঠন, ব্যবসায়িক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, অর্থনৈতিক সংগঠনের সাথে সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ন রাজনৈতিক সংগঠনও থাকবে।

সমস্যা হলো- এখন এই রাজনৈতিক সংগঠনই 'বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী' কি না? এটা নিয়ে ডিবেট আছে। রাজনৈতিক সংগঠনের অধীনেই সকল অন্যান্য সংগঠন নিয়ন্ত্রনাধীন কি না? উত্তর দেয়া যতটা কঠিন, আবার ততটাই সোজা। এখন জামায়াতকে তার দর্শন সুনির্দিষ্ট করাটা অত্যাবশ্যক। জামায়াতকে মাদার সংগঠন হিসেবে রিপ্রেজেন্ট করতে পারলে ইন্সট্যান্ট দুটি লাভ।
একঃ
সকল ইসলামী একটিভিজমের কেন্দ্রবিন্দু হবে মাদার সংগঠন। অন্যান্য ইসলামী দলকেও পেট্রোনাইজ ও অভিভাকত্ব করার একটা স্পেস তৈরী হবে।
দুইঃ
এখন যত সমালোচনা ও কথা হচ্ছে- তা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম নিয়ে। যার দায় কোনভাবেই আল ইসলাম নিতে পারে না। আর মানুষের নেতৃত্ব নিয়ে সব সময়ই কথা ও সমালোচনা হতেই থাকবে। রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের কর্মসূচির দায় তখন কেবমমাত্র রাজনৈতিক উইং ই বহন করবে।

বাংলাদেশে জামায়াতের এক অমিত সম্ভাবনা আছে। একদল জানবাজ, যোগ্যতা সম্পন্ন, নির্ভিক, মেধাবী জনগোষ্ঠি ইসলামী আন্দোলনের সাথে নিজেদের জীবনকে মিলিয়ে নিয়েছে। তরুণ প্রজন্মের বিশাল একটা অংশ ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত। এসব আমানতকে যোগ্যতার সাথে ব্যবহার করা নেতৃত্বের দায়িত্ব ও কর্তব্য। বলা হয়ে থাকে- ''ইসলামী আন্দোলনের বিজয়ী হলো কি না তা গৌণ বিষয়, ব্যক্তি হিসেবে আমি জান্নাত পেলাম কি না- সেটিই মুখ্য বিষয়।'' এই কথাটি সাধারণ কর্মীদের জন্য প্রযোজ্য। কেয়ামতের দিন নেতৃত্বকে অবশ্যই ইসলামী আদর্শকে অন্যান্য আদর্শের উপর বিজয়ী করার ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। আল্লাহ্‌র রাসূল এই জমীনে এসেছিলেনঃ

"আল্লাহই তো সে মহান সত্তা যিনি তাঁর রসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন দিয়ে পাঠিয়েছেন যেন তাকে সমস্ত দ্বীনের ওপর বিজয়ী করে দেন। আর এ বাস্তবতা সম্পর্কে আল্লাহর সাক্ষই যথেষ্ট।" (সূরা ফাতহঃ ৪৮ঃ২৮)

1 comment:

  1. আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক

    ReplyDelete