Wednesday, November 2, 2016

জাকির নায়েক এবং ইতিহাসের ধারাবাহিকতা


একদিন সন্ধ্যায় সাংগঠনিক বন্ধুদের সাথে টিভি স্পেসে বসে আছি। সকলেই বিশ্ববিদ্যালয় শাখার দায়িত্বশীল। এক বাসায় ঘুমাই। সম্ভবত ২০১১ অথবা ২০১২ সালের ঘটনা । ডা. জাকির নায়েক তখন বাংলাদেশে তুমুল জনপ্রিয়। পিস টিভি বাংলার কোটি দর্শক। জাকির সাহেবের 'থিওলজী' নিয়ে অসাধারণ পান্ডিত্য, অনুপম যুক্তি, এক্সক্লুসিভ উপস্থাপনা, তাৎক্ষণিক প্রশ্নের হৃদয় জুড়ানো উত্তর, জাহেলিয়াতের উত্তাল তরঙ্গের মাঝে কর্পোরেট বিজ্ঞাপন ছাড়াই ইসলামী টিভি স্টেশন পরিচালনা- সবকিছু আমার মত শত-হাজারো-লাখো যুবককে সম্মোহিত করছিল। রাতের একটা অংশ পিস টিভি না দেখলে যেন চলতোই না।

বাসায় একদিন লঙ্কাকান্ড বেঁধে গেল। একজন দেখবে ক্রিকেট ম্যাচ আরেকজন পিস টিভি। ক্রিকেট খেলা দেখা আর পিস টিভি দেখা নিয়ে এক ডিবেট শুরু হলো। দু'জনেই আত্মপক্ষ সমর্থন করে যুক্তি ও তথ্য উপস্থাপন করে নিজেদের মতকে সর্বাত্মক উপায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছিল। যখন তর্ক শুরু হয়, তখন বিষয়সুচী আর ঠিক থাকে না। মূলতঃ কোন চ্যানেল দেখা হবে- সেটি নিয়ে যুক্তিতর্ক শুরু হলেও এক পর্যায়ে তা ডা. জাকির নায়েকের ফিলোসফি এবং তার মিশন সংক্রান্ত ডিবেটে রুপান্তরিত হলো। সেদিন ক্রিকেট পক্ষীয় ভাই ডিবেটের মাঝে হঠাৎ একটা প্রশ্ন করে বসলেন। সেই প্রশ্ন আমার চিন্তার রাজ্যে ঝড় বইয়ে দিয়েছিল।

প্রশ্নটি ছিল- আল্লাহ্‌র রাসূল যেখানে দাওয়াতী কাজে পৌত্তলিকদের পক্ষ থেকে বাঁধাগ্রস্থ হয়েছেন, সেখানে কেন পৌত্তলিক রাষ্ট্রে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে তাওহীদের অবিরত দাওয়াতী কাজ করেও জাকির নায়েক বাঁধার মুখোমুখি হচ্ছেন না?

আমি সেদিন থ' হয়ে গিয়েছিলাম। বলে রাখি- আমি ডা. জাকির নায়েক সাহেবের প্রচন্ড ভক্ত। হৃদয়ের গভীরে উনাকে জায়গা করে দিয়েছি। ব্যক্তি জাকির নায়েক নয়; বরং 'দায়ী ইলাল্লাহ' জাকির নায়েক আমার প্রিয়তম। এই প্রশ্ন আমাকে প্রিয় মানুষটিকে 'হকের কষ্টিপাথরে' মাপতে বাধ্য করলো। চিন্তাগুলো উলট-পালট হতে লাগলো। ভাবনারা এসে বলছিল- তাই তো ! বোম্বাই শহরে বসবাস করে 'ইসলামিক রিচার্স ফাউন্ডেশন' পরিচালনা করছেন, পিস টিভির মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী দাওয়াতী কাজ আঞ্জাম দিচ্ছেন, হাজারো মূর্তিপূজকদের ইসলাম কবুল করিয়ে তাওহীদের পতাকায় সমেবত করছেন, যুক্তি দিয়ে মূর্তিপূজকদের বিশ্বাসের দেয়ালকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছেন- অথচ ন্যূনতম কোন বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছেন না। এটা কি করে সম্ভব? আদম (আঃ) থেকে শুরু করে অদ্যবধী যারা তাওহীদের পতাকাবাহী হয়েছেন, প্রত্যেককেই ঈমানের অগ্নী পরীক্ষায় নিখাঁদ প্রমাণিত হতে হয়েছে। এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট মানুষটিকে উহুদের ময়দানে দাঁত হারাতে হয়েছে। অথচ সেই তাওহীদের দাওয়াত দিতে গিয়ে ডা. জাকির নায়েক কোন বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে না কেন? হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হলো তখন। তাহলে কি আমি ভূল মানুষকে ফলো করছি? ভুল দায়ী ইলাল্লাহর ফাঁদে পড়েছি? ভুল কিছু নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে যাচ্ছি? মনে প্রচন্ড এক অস্বস্তি নিয়েই অপেক্ষা করছিলাম।

জুলাই ২০১৬। গুলশানের হলি আর্টিসানে কিছু বিপথগামী হামলা করলো। বিদেশী নাগরিক সহ ২০ জন নিহত হলো। টেরোরিষ্টদের ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে হামলার 'মাস্টারমাইন্ড এন্ড ইনফ্লুয়েন্সিভ লিডার' হিসেবে ডা. জাকির নায়েককে চিহ্নিত করা হলো। ডা. জাকির নায়েকের সাথে কোন যোগাযোগ না থাকলেও বলা হলো পিস টিভি দেখে আর তার বক্তব্য শুনেই সন্ত্রাসীরা উদ্বুদ্ধ হয়েছে। আর যায় কোথায়? বাংলাদেশের মিডিয়ার সুড়সুড়ি লাগলো, কিছুক্ষণ বাদে চুলকানী শুরু হলো, তারপরে খাউজানি। ব্যস, তাতেই বাংলাদেশে পিস টিভি বন্ধ হলো, ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করলো। বাংলাদেশের পবিত্র সরকার মানবাধিকারের স্বার্থে ভারতে ডা. জাকির নায়েককে নিষিদ্ধ করার আহবান জানালো। হজ্জ করে সৌদি থেকে আর ফেরা হলো না বুম্বাইয়ে। ভারতের সরকার তার এনজিও প্রতিষ্ঠান ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনকে একটি অবৈধ সংস্থা বলে ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। বেআইনি কার্যক্রম (প্রতিরোধ) আইনে তার এই সংস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করা হবে। অপরদিকে আপত্তিকর মন্তব্যের কারণে তার বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলার খসড়া এরই মধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। সেইসঙ্গে তার পিস টিভির বিরুদ্ধেও মামলার খসড়া হয়েছে।

গত পরশু ডা. জাকির নায়েকের সম্মানিত পিতা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। একজন সন্তান হয়ে পিতার জানাযায় আসতে পারলেন না জনাব জাকির নায়েক। সদা হাস্যোজ্জ্বল জাকির সাহেবের মনের ব্যাথা ও কষ্ট একটু চিন্তা করলেই উপলব্ধি করা সম্ভব। পিতা ডাঃ করিম নায়েকের জানাযায় দেশটির সিটি ক্রাইম ব্রাঞ্চ, ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি এবং স্থানীয় থানা পুলিশের বেশ উপস্থিতি ছিল। জাকির নায়েক কোনভাবে জানাযায় আসলেই তাকে গ্রেফতার করা হতো। বলা যায়- ভারত থেকে একপ্রকার হিজরত করতে হয়েছে। ভবিষ্যতে জন্মভূমির মাটিতে হয়তো তার দাফনও হবে না।

২০১২ সালের ঐ সন্ধ্যার প্রশ্নের উত্তর আজ ২০১৬ সালের শেষে এসে পেয়ে গেলাম। আমার প্রিয় মানুষটি যে সত্যিই 'হকের উপর' দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং আছেন- তা নিয়ে পৃথিবীর সকলে সন্দেহপ্রবণ হলেও অন্তত আমি নিশ্চিন্ত। যুগে যুগে এভাবেই সত্যাশ্রয়ী দায়ী ইলাল্লাহদের মানসিক ও শারীরিক কষ্ট দেয়া হয়েছে। কেউ শাহাদাতে সুধা পান করেছেন, কেউ নির্যাতনের স্টিম রোলার সহ্য করেছেন, কেউ জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়ে হিজরত করেছেন। পিতার জানাযায় আসতে না পারা, ভারতে অবাঞ্চিত ঘোষিত হওয়া, বাংলাদেশের ফ্যাসীবাদী সরকারের কোপানলে পড়া, নাস্তিক ও অমুসলিমদের প্রোপাগান্ডার লক্ষ্যবস্তু হওয়া সহ তার প্রতি চলমান অবিচার ও জুলুমের মাধ্যমে মূলতঃ ইসলামের ধারাবাহিক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলো এবং মুহতারাম ডা. জাকির নায়েক সাহেবের সত্যের পথের নকীব হওয়ার সার্টিফিকেট অর্জিত হলো।

লাভ ইউ ডা. জাকির নায়েক। আপনি ইতিহাসের নকীব। ইনশাআল্লাহ্‌- পৃথিবীব্যাপী জুলুম-অবিচারের অবশ্যই অপনোদন ঘটবে। এই পৃথিবী সাম্য ও ইনসাফের পৃথিবী হয়ে উঠবে। যতদিন তা হবে না, ততদিন আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ্‌। সুযোগ থাকলে একজন বাংলাদেশী হিসেবে আমি ডাক্তার সাহেবের কাছে ক্ষমা চাইতাম। উনার বিচক্ষনতা আর পবিত্রতার নূরে পৌত্তলিকরা বিরুদ্ধাচারন করার ইস্যু পাচ্ছিলো না। আক্রমনের শুরুর হাতিয়ার পাচ্ছিলো না। বাংলাদেশের কুশীল মিডিয়া, বাকশালী বিনা ভোটের সরকার এবং ইসলামদ্রোহী শক্তির সম্মিলিত সফল প্রোপাগান্ডায় ওনাকে আজ কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। গুলশানের ঘটনার শিকার হয়ে ওনি আজ জন্মদাতা পিতার জানাযায় অংশ নিতে পারলেন না। প্রিয় মানুষটির প্রতি অবিচারের সাথে বাংলাদেশের নামও জড়িত। এটা আমার কাছে অনেক কষ্টের। আমি যদি পারতাম ডাঃ জাকির নায়েক সাহেবকে বলতাম- এই জালিম চরিত্রের বাংলাদেশ সত্যিকারের বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি নয়; আমরা এই বাংলাদেশকে নয়- এক ইনসাফের বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে আপনাকে ভালবাসি।

ফুটনোটঃ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের খড়গে পড়ে আমরা অন্যান্য দেশের মানুষদের প্রতি জুলুম-অবিচার নিয়ে সোচ্চার হই না। অথচ পৃথিবীর একেবারে শেষ প্রান্তের মানুষের প্রতি অবিচারের বিরোধীতা করাও ইসলামের প্রাণস্ত্বার দাবী। মনে রাখা দরকার- শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীব্যাপিই সত্যাশ্রয়ীরা আজ মজলুম। অনলাইন একটিভিষ্টদের দেশীয় জুলুম-অবিচারের সাথে গ্লোবাল জুলুম-অবিচার নিয়ে সোচ্চার হওয়ার উদাত্ত আহবান করছি। তাতে আহামরী কোন রেজাল্ট আসবে না হয়তো, কিন্তু ঈমানের দাবী তো মিটবে?

0 comments:

Post a Comment