Monday, December 19, 2016

জামায়াত সংস্কারঃ কিছু কথা

এক, 
গত কয়েক মাস ধরে 'জামায়াত সংস্কার'- শিরোনামে তুমুল কথা হচ্ছে। সত্য এটাই যে প্রচুর কথা হচ্ছে। নিরেট সাংগঠনিক জনশক্তিরা সংগঠনের অভ্যন্তরে, সংগঠনের সাহিত্যপ্রেমী ও লেখালেখি প্রিয় জনশক্তি অনলাইনে এবং জামায়াতে বিরোধী বলয় তাদের মোক্ষম অস্ত্র মিডিয়াতে জামায়াত সংস্কার নিয়ে কথা বলছে। ঝড়ের সময়ে বালুর নিচে মুখ লুকিয়ে যতই বলা হোক- ঝড় বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব নেই, তাতে ঝড় থামে না। ঝড় শেষে মুখ তুলে দেখতে হয়- অনেককিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। বিচক্ষনরা ঝড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রয়োজনীয় জিনিসকে সাহসের সাথে হেফাজত করে। আমি অনেক ভেবেই এ বিষয়ে কিছু কথা বলার ইচ্ছে পোষণ করছি। একজন তৃণমূলের কর্মী কিভাবে জামায়াতকে নিয়ে ভাবে, কিভাবে আকাংখা করে, কিভাবে কষ্ট পায়- তা উর্ধতনদের জানা দরকার। আমার এ লিখাই একজন তৃণমূলের কর্মীর হাহাকার থাকবে, অনেক ভুল ধারনা উপস্থাপিত হবে। আমি চাই- শীর্ষ নেতৃত্ব জানুক, কর্মীরা কি কি ভুলের মাঝে আছে। এর মাধ্যমে হয়তো কর্মীরা সঠিক তথ্য পাওয়ার একটা মওকা পাবে। ।




দুই, 
যারা এতটুকু পড়েই আমাকে সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙ্গের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইছেন, তাদেরকে আমার কিছু বলার নেই। শুধু বলবো- কাঠগড়াতে উঠানোর আগে অন্তত কষ্ট করে আমার এই বিশৃঙ্খল চিন্তা্গুলো একবার জেনে নিন। তাতে ভবিষ্যতে অনেককে কাঠগড়ায় তোলা থেকে বেঁচে যাবেন। আবার কেউ কেউ ভেবে বসবেন- কেন অনলাইনে লিখছি। শীর্ষ নেতৃত্বকে কি অন্যভাবে কথাগুলো বলা যেতো না? উত্তরে বলি- হ্যাঁ, যেতো। তাতে নেতৃত্ব পাবলিক রিএকশ্যন জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতেন। এখন আমার এই লিখাগুলোকে যেভাবে ইচ্ছে নিতে পারেন।



(প্রথম পর্ব:) 
মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদীর মহাসংস্কারঃ তারপরের নেতৃত্বের স্থবিরতা-




উপমহাদেশে 'মোকছেদুল মোমেনীন' অথবা 'ফাজায়েলে আমল' মার্কা নিরামিষ ইসলামের ভরা জোয়ারের মাঝে চল্লিশের দশকে সর্বপ্রথম 'জীবন ব্যবস্থা' হিসেবে এক বৈপ্লবিক ইসলামের প্রানস্ত্বাকে তুলে ধরলেন সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী (রঃ)। এ এক অনন্য সংস্কার। ইসলাম যে কেবলমাত্র 'ধর্ম' পরিচয়ে প্রকৃতভাবে উপস্থাপিত হয় না, বরং এটি ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল স্তরের গাইড- তা সম্ভবত ভারতীয় উপমহাদেশের আবুল আলা'ই এই সাব-কন্টিনেন্টে প্রথম একাডেমিক ও প্র্যাক্টিক্যালী প্রমাণে সচেষ্ট হোন। চল্লিশের দশকের আগে এই উপমহাদেশে ইসলামের কোন দর্শন ছিল না; স্রেফ সুফী-সাধকের বাউন্ডলেপনা আর সাধারণ মুসলমানের আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্ম ছিল। মাওলানা মওদূদী ধর্ম হিসেবে প্রচলিত ধারণার মূলোৎপাটন করে এক রেভ্যুলুশনারী সিস্টেম হিসেবে ইসলামের দর্শন জনতার সামনে উপস্থাপন করলেন। কল্পনা করতে পারেন- দর্শন ডিফাইন করাটা কত বড় কঠিন ও ঝুঁকির কাজ? কত বড় সংস্কার কর্মসূচী? মাওলানা তৎকালীন পাকিস্তানের নেতাদের খেয়ালীপনা ইসলামিক বিপ্লবের আকাস-কুসুম কল্পনার অন্তঃসারশূন্যতা তুলে ধরেছিলেন। ওনি সবার মত করে ভাবেন নি। সবাই এক জোয়ারের দিকে ছুটেছেন আর তিনি সেই জোয়ারের বিপরীতে হেঁটেছেন। ভারত ভাগ করে পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম করে যারা ইসলামের বিজয় কেতন উড়িয়ে জয়োল্লাস করেছিলেন, মাত্র ৩৪ বছরে তারাই জুলুম-নির্যাতন করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হয়ে ওঠার ভিত্তি গড়ে দিলেন। দিল্লীর তাঁবেদারি থেকে মুক্ত করার পর নিজেরাই ইসলামাবাদে তাঁবেদার সেজে বসলেন। মাওলানা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ইসলামের বিপ্লবের পদ্ধতি নিয়ে যা বলেছিলেন- বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাধ্যমে সেটিই দারুণভাবে প্রমাণিত হয়েছিল। আমগাছ থেকে জাম ফল আশা করা যায় না। মাওলানা এভাবেই প্রজ্ঞার সাথে কথা বলতেন। 




মাওলানা মওদুদী 'ইসলামী বিপ্লবের পথ' বাতলে দিয়ে একটা বক্তৃতা দিলেন ( পরের আলোচনার সুবিধার্তে একটা নোট নিয়ে রাখুন- এটা একটা বক্তব্য, যা এখন বই আকারে আমরা পড়ি)। আন্দোলনের সফলতার কিছু শর্ত নির্ধারণ করে দিলেন। লিখালিখির মাধ্যমে পলিটিক্যাল ইসলামের দর্শনের একটা বিস্তারিত রূপরেখা তুলে ধরলেন। আপনি একবার ভেবে দেখুন- কি নিয়ে ওনি লিখেন নি। অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, রাজনীতি, শিল্প, সংস্কৃতি, ব্যবসা, ইবাদাত, সরকার পদ্ধতি, তুলনামূলক ধর্মতত্ত সহ চলমান প্রৃথিবীর প্রায় সব ইস্যুতে ওনি নিদারুন কষ্ট করে লিখলেন। একাডেমিক্যালি 'জীবন ব্যবস্থা' ইসলামের চেহারা তুলে ধরলেন। মানুষ উদ্বেলিত হলো। দলে দলে মানুষ এই দর্শনে প্রভাবিত হলো। পাকিস্তান থেকে উপমহাদেশ ছড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে পৃথিবীব্যাপী সে আলোর মশাল বিস্তৃত হলো। সমকালীন সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে হাসানুল বান্নার ইখওয়ান যেন আপন ভাই হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে পেয়ে গেল। তুমুল বেগে ঢেউ উঠলো মুসলিম মানসে। 






আজ ২০১৬ সাল। মাওলানা মওদূদী (রঃ) ইন্তেকাল করলেন ১৯৭৯ সালে। এক যুগ সংস্কারক ঘুমিয়ে গেলেন। অত্যন্ত দূঃখের সাথে বলতে হয়- তার কবরের সাথে সংস্কার কর্মসূচীও ঘুমিয়ে গেল। অনেকে অভিযোগ তোলেন- জামায়াত মওদূদীবাদী। আমরা যারা সংগঠনের কর্মী তারা জানি- জামায়াত ব্যক্তি মওদুদীকে নিয়ে এতটুকুও কনসার্ন নয়। 'উসওয়াতুন হাসানা' রাসূল সাঃ ই আমাদের একমাত্র আদর্শ। এখন আমি কিছু ব্যাপারে আমি প্রশ্ন তুলতে চাই।

(ক)
'ইসলামী বিপ্লবের পথ'- বক্তব্য (যা এখন বই) কি ২০১৬ সালে এসেও খুব বেশী প্রাসঙ্গিক? ইসলামী বিপ্লবের পথ বইয়ে যেভাবে বিপ্লবের পথ বাতলে দেয়া হয়েছে, সেটি ৬৮ বছর পরেও হুবহু প্রাসঙ্গিক কি না? জেনে রাখুন- মাওলানা যেসময় এই বক্তব্য দিয়েছেন, তখন রাষ্ট্র-কাঠামো এভাবে ছিল না। আর বক্তব্য কি কয়েক দশক পরের বাস্তবতাকে সামনে রেখে দেয়া হয়? না কি তৎকালীন বাস্তবতার আলোকে সেসময়ের জনশক্তিদের করণীয় হিসেবে দেয়া হয়? আমি ধরে নিলাম- বিপ্লবের পথ বক্তব্যের অনেক কিছুই কেয়ামত পর্যন্ত একই থাকবে; কিন্তু নিশ্চয় একমত হবে সবকিছু অপরিপর্তিত নেই। বর্তমান সময়ে বিপ্লবের জন্য আরো কিছু ইস্যুতে হাত দিতে হবে। সেটি ঐ বইয়ে বাতলে দেয়া হয় নি। অথচ এখনো জনশক্তিদের ঐ বইকে ঠোতস্থ করতে হয়। আমি বলি- অতীতের বাতলে দেয়া পথ এখনকার জনশক্তিদের জন্য খুব বেশী প্রাসঙ্গিক নয়। ইসলামী বিপ্লবের সেই বাতলে পথের সাথে এখন সংযোজন/ বিয়োজন অপরিহার্য। কেউ কি কখনো এসব ভাবছেন? 




(খ)
ইসলামী আন্দোলনঃ সাফল্যের শর্তাবলী বইয়ে একটি ইসলামী আন্দোলনকে সফল করার জন্যে বেশ কিছু শর্ত নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বইটি চল্লিশের দশকে লিখা। আমি বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করছি- ২০১৬ সালে এসেও কি সেই শর্তগুলোই প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে? এই ৬০/৭০ বছরে কোন শর্ত যুক্ত হয় নি। কোন চ্যালেঞ্জ নতুন করে আসে নি? সমাজব্যস্থার ধরন ও কাঠামোর কোন পরিবর্তন হয় নি? কেউ কি এই ৭০ বছরে নতুন কোন শর্ত যুক্ত করে দিতে পারলো না? 




(গ) চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান বইয়ে চরিত্র গঠনের জন্য নঈম সিদ্দিকী কিছু মৌলিক উপাদানের কথা বলেছেন। আমি বিনয়ের বলি- আধুনিক জাহেলিয়াতের এই ভরা যৌবনে চরিত্র গঠনের জন্য চল্লিশের দশকে বাতলে দেয়া নঈম সিদ্দিকী বর্ণিত ৪ টি গুনাবলীই কি কালজয়ী? আচ্ছা নঈম সিদ্দিকী কি সেই সময়ে অনলাইন জাহেলিয়াতের কথা জানতেন? একজন প্রতিটি ঘরে ভার্চুয়াল পতিতালয় আছে-তা কি ওনি মাথায় রেখেই চরিত্র গঠনের উপাদানগুলি বর্ণনা করেছিলেন? নতুন কোন উপাদান কি চরিত্র গঠনে প্রয়োজন নেই? 




আমি মাত্র তিনটি বইয়ের ফুটনোট দিলাম। এভাবে অনেকগুলো বইয়ের নোট দেয়া যায়। যে মহাবিপ্লবী, মহাসংস্কারক এক নিরামিশ পরিবেশে ইসলামের বৈপ্লবিক উত্তাল তরঙ্গকে এনে দিলেন, মৃত্যুর সাথে সাথে সেই সংস্কার প্রক্রিয়া থেমে গেল। আমি মনে করি- মাওলানা সেই তখন সময়োপযোগী সংস্কারই করে দিয়ে গেছেন। আমরা কেন সেখানেই পড়ে আছি? কেন বিপ্লবের পথ নিয়ে চিন্তাধারা থমকে আছে? কেন বিপ্লবে সাফল্যের শর্ত নিয়ে ভাবা হচ্ছে না? কেন চরিত্র গঠনের নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সলিউশ্যুন দেয়া হচ্ছে না? জানি না, আমি ভুল ভাবছি না। মাওলানা মওদূদীর এসব একাডেমিক ডেফিনিশনের সম্পূরক লিখনি কি আদৌ প্রয়োজন আছে বলে কি বর্তমান নেতৃত্ব ভাবছে? আমি কম জানাশোনার লোক। হয়তো এসবের আদৌ কোন প্রয়োজন নেই। মাওলানা যা বলে গেছেন- তা ই যথেষ্ট। এখন শুধু কাজ করে যেতে হবে। অথবা হয়তো ইতোমধ্যেই সম্পুরক একাডেমিক সংযুক্তি হয়েছে। আমি সবিনয়ে জানতে চাই- সেগুলোর তালিকা কি পেতে পারি?

এ ব্যাপারে আমার একটা দুঃখবোধ আছে। মাওলানার একাডেমিক সংস্কারের বর্তমান সংস্করণের জন্য বেশী যোগ্য ছিলেন মরহুম প্রফেসর গোলাম আযম, মরহুম মাওলানা আব্দুর রহীম (রঃ) এবং মরহুম মাওলানা আব্বাস আলী খান (রঃ)। আমার জানামতে মাওলানা বর্নিত ইস্যুগুলোতে ওনারাও কোন হাত দেন নি। নতুন অনেক বিষয়ে লিখেছেন, তবে মৌলিক কিছু বিষয় অক্ষতই রয়ে গেছে। মাওলানা পরবর্তী নেতৃত্ব কেবল কর্মসূচী নিয়ে কাজ করেছে; দর্শনগত মৌলিক ইস্যুকে সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছে। একটা স্থির নদীতে মাওলানা যে উত্তাল গর্জন তুলেছিলেন, তা আবারো স্থির হয়ে গেছে। সবাই কাজ নিয়ে নিদারুণ পেরেশান। দর্শনে আদৌ কোন কারেকশন প্রয়োজন কি না, তা ভাবারও যেন সময় নেই। কাজ আর কাজ। 'শুধু কাজ করে যাও; সফলতা আসবেই'- যেন এক অঘোম বার্তা। মাওলানা যে দর্শন দাঁড় করালেন, তার শানে নুযুল জানার আমাদের যেন কোনই ইচ্ছে নেই। একটি গাড়ি স্টার্ট দেয়ার সময়ে ড্রাইভার যা যা করেন, একটু পরে দ্রুত লক্ষ্যপানে পৌছতে আরেকটু কাজ করতে হয়। গিয়ার চেঞ্জ করতে হয়। ফাঁকা রাস্তায় চার নম্বর গিয়ারে ছোটা যায়। আবার সামনে কিছু এলে ব্রেকও করতে হয়। স্টার্টিং ড্রাইভার যা কিছু করেছে- তা ই স্বতঃসিদ্ধ কালোত্তীর্ণ হিসেব নয়।


মনে রাখা দরকার- কোন কর্মসূচী বাস্তবায়নের আগে তার পেছনের দর্শনটা ঠিকঠাক থাকা চাই। তাতে কর্মসূচী বাস্তবায়নকারী জনশক্তির মানসিক দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায়। 





0 comments:

Post a Comment