Wednesday, November 2, 2016

সোস্যাল মিডিয়াতে আসলে কি লিখবো?

পরিচিত অনেকজনকে ফেসবুক ডিএকটিভ করে দিতে দেখছি। অনেকেই ভাবছে। 
পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে আমিও সে ভাবনার কাছাকাছি। তবে নিশ্চিত আমি ফেসবুক বন্ধ করে থাকতে পারবো না। আর থাকতে পারবো না বলেই আজ কিছু কথা বলছি। বিনয়ের সাথে ক্ষমাপ্রার্থী।

এক,
বড় সংকট হলো- ফেসবুককে আমরা ব্যক্তিগত ডায়েরী ভেবে বসি। খেয়াল করে দেখবেন- "ডায়রী'' টার্মের চেয়ে "ব্যক্তিগত ডায়েরী" টার্মটিই বহুল পরিচিত। ব্যক্তি "আমি" কে ডায়রীতে লিখে রাখলে, তাতে অন্যে কারো এক্সেস থাকে না। ফেসবুক এখানেই ডিফার করে। ফেসবুককে পড়ার টেবিলের বইয়ের গাঁদার নিচে লুকিয়ে রাখা যায় না। সোস্যাল নেটওয়ার্ক। এটা একটা উন্মুক্ত মঞ্চ। হাজারো শ্রোতা, হাজারো দর্শক। আপনি যা লিখছেন, বলছেন, আপলোড করছেন- তা হাজারো মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। ওপেন ওয়ার্ল্ড। আজ থেকে ৫ বছর আগে শুধু উঁচু তলার লোকেরা মাইক্রোফোনের এক্সেস পেত; জুকারবার্গের যুগান্তকারী সৃষ্টির কল্যাণে আজ আমি-আপনি ১০/২০ হাজার মানুষের কাছে পৌছার এক্সেস পেয়েছি। এখন আর কেউ কাউকে দাবায়ে রাখতে পারবে না।

দুই,
জীবনকে আপনি কিভাবে দেখেন। গ্লাসের অর্ধেক পানিতে ভরা আর অর্ধেক খালি ফাঁকা। আপনাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়- গ্লাসে কি ? আপনার জীবন দর্শনই ঠিক করে দিবে উত্তর। অপটিমিষ্টিক, পজেটিভ হার্ট খুব ন্যাচার‍্যালী বলে উঠবে অর্ধেক পানিতে ভরপুর গ্লাস। আর হতাশার সাগরে সাঁতরে বেড়ানো কুঁকড়ে যাওয়া নেগেটিভ হৃদয় সেখানে কেবল অর্ধেক খালি গ্লাসই দেখতে পাবে। সত্যিই স্রষ্টার ইচ্ছায় বাই চয়েজ ডেভেলপিং কান্ট্রিতে জন্ম নেওয়া আমরা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার মুখোমুখি। এখানে আকাশের নিচের অধিকাংশ বনি আদমকেই প্রতি নিয়ত টিকে থাকার লড়াই করতে হয়। ভালবাসার রংয়ের চাদরে মোড়া শৌখিন খাটের গল্প এখানে খুবই কম সংখ্যক মানুষের জীবনের সাথে মিলে। কষ্টের সেতু পাড়ি দিয়েই দুঃখ নদীর স্রোত। সে স্রোতে কত মাঝিই পথ হারায়? আর অকুতোভয় যাত্রীরা ভয়ংকর স্রোত পাড়ি দিয়ে তীরে উঠতেই বাঘ, সিংহ, সর্প আক্রমন করতে হা করে থাকে। ক্ষুধা আর দারিদ্রতা যেন আমাদের নাছোড়বান্দা প্রেমিক/প্রেমিকা ! এখানে একটুখানি প্রাপ্তির শীতল হাওয়া শত অপ্রাপ্তির গরম মিছিলে নিমেষেই উবে যায় ! এখানে স্বপ্নেরা অধরা বরাবরই।

তিন, 
এখন আপনি কিভাবে সোস্যাল নেটওয়ার্কে নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করবেন? স্বস্তিহীন, প্রাপ্তিহীন, হতাশাগ্রস্থ, অশান্তচিত্ত হৃদয়কে? না কি এর মাঝেই জীবনকে উপভোগ করার রসদ খুঁজে নিবেন? প্রতি স্ট্যটাসে বেদনার নীল ছড়াবেন, না কি আশার মশাল বয়ে নিয়ে চলবেন? একটি ক্লান্ত, বিষন্ন, অসহায় জীবনের মুর্ত প্রতীক হবেন, না কি সাবলীল, স্মোথ, উপভোগ্য জীবনের ইতিহাস লিখবেন? আমি বিনয়ের সাথে বলি- ব্যক্তি জীবনকে এভোইড করে ইউনিভার্সাল ইস্যুতে লিখুন, বলুন, ভাবুন। এই জীবনে লিখার ইস্যুর কি শেষ আছে বলুন? বিশেষ করে, আমাদের দেশ ও সমাজব্যবস্থা তো "অব্যাহত ইস্যুর জনক"। প্রত্যেকের জীবনেই অপ্রাপ্তি আছে। আমার-আপনার-সকলের। সেটি ফেসবুকে লিখলে প্রাপ্তির ঘরে চলে আসে না। বরং অন্যেরা আপনার ব্যক্তিত্বের দূর্বল পার্টসকে লোকেট করে ফেলে। জীবনকে শুধু 'আমি' নামক সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে না দেখে গ্লোবাল পারস্পেকটিভে দেখুন। আমার ছোট্ট অবজার্ভেশন হচ্ছে- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী ও ভোগবাদী শব্দ হলো- "আমি''।

চার, 
একবার ভাবুন- ফেসবুকে আপনার যারা ফ্রেন্ডস ও ফলোয়ার, তারা আপনার মাঝে জ্যোৎস্নার আলোয় ভরপুর এক অনিন্দ্য সুন্দর জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখতে চান। আপনার প্রশান্ত চিত্ত আত্মাকে উপলব্ধি করতে চান। এই সহজাত আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে সর্বদা নিজেকে হীনমন্য করে উপস্থাপন করলে, আপনার বন্ধুরা কষ্ট পান, আশাহত হোন। ভার্চুয়াল দুনিয়াতেও কষ্টেরা এসে তখন প্রাসাদ গড়ে। বাস্তবিক জীবনে কষ্টের পাহাড়ে থাকতে পারেন, তাই বলে ভার্চুয়াল জগতেও এত কষ্টের নীল ছড়িয়ে কি লাভ বলুন? সবাই ফিল করে ভার্চুয়াল জগৎ আনন্দে ভরপুর। বি পজেটিভ। রাইট পজেটিভ। মেক এ পজেটিভ ইন্টারফেস!

পাঁচ, 
আমি টাইমলাইনে কিছু মানুষের এই দুঃখ-গাঁথার কথা পড়তে পড়তে ক্লান্ত। ব্যক্তি জীবনে তাদের প্রাপ্তির খাতাটাও দেখেছি। কত সুন্দর তাদের জীবন। অথচ...... . 
ছোটবেলায় যখন মুনির খান, আসিফের গান শুনতাম। প্রতিটি গানের লিরিক্স অবজার্ভ করে ভাবতাম- ওনারা কতটা দুঃখী মানুষ। উফ। অঞ্জনারা এভাবে কষ্ট দিয়েছে মুনিরদের? কিন্তু আজ বড় হয়ে বুঝি- অঞ্জনা, নীলাঞ্জনাদের দেয়া 'মেকী' কষ্টকে ওনারা সফলভাবে বাংলাদেশের মানুষদের হৃদয়ে প্রোথিত করে দিয়ে বাস্তব জীবনে সূখের নদীতেই নৌকা বইছেন। আমরা সবাই আসিফ, মুনিরদের মত ব্যর্থ প্রেমের লিরিক্স লিখতে ভালবাসি। বড্ড ভালবাসি। বলা হয়- দুঃখ জিনিসটা ইলাস্টিকের মত। টানতে মজাই লাগে ! টানলেই লম্বা হয়। অনেক লম্বা। তবে প্রজ্ঞাবানরা, ততবেশী টানেন না, যতটা টানলে তা ছিঁড়ে যায়।

হ্যাপি ফেসবুকিং এন্ড ইনজয় দ্যা মুমেন্টাম :D

0 comments:

Post a Comment